ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকায় নির্মিত হচ্ছে ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:১৪

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ০৯:৫৪

ছবি: সংগৃহীত

পরিবেশ টিভি: বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ ফাউন্ডেশনসহ দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উৎকণ্ঠার মধ্যে এবার সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে মোংলায় বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হচ্ছে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ১০ কিলোমিটার ইসিএভুক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৭ একর জমির উপর পাওয়ারপ্যাক নামে ১০০ মেগাওয়ার্ট এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবকাঠামো নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেছেন, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। আর এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্ট ও পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছে দাবি নির্মাণাধীন পাওয়ারপ্যাক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্র্তৃপক্ষের।

এদিকে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, বিদুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ হলে আবারো সুন্দরবনের ‘শেলা ট্রাজেডির’ সৃষ্টি হবে। অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন। তারা দাবি জানিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার।

পরিবেশবিদরা বলছে ‘দেশের অক্সিজেনের ভান্ডার’ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির জীবন্ত হুমকি হচ্ছে ফার্নেস অয়েল। দেশের সর্বমোট বনাঞ্চলের ৫১ ভাগই হচ্ছে সুন্দরবন। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর মোংলার অদুরে সুন্দরবনের শেলা নদীতে ৩ লাখ টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডুবে যায় ‘সাইন স্টার-৭ নামের একটি অয়েল ট্যাঙ্কার। দিনে দু’বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত বিশে^র বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের কয়েক লাখ হেক্টর বনভূমির গাছের শ্বাসমূলসহ নদী-খালে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস অয়েল। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি, বিলুপ্ত প্রাজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২৯২ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। তখন সুন্দরবনকে বাঁচাতে খোদ জাতিসংঘের ২৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলকে ছুটে আসতে হয় সুন্দরবনে। সুন্দরবনে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লেগেছে। এখন ম্যানগ্রোভ এই বনের পশুর চ্যানেল দিয়ে অয়েল ট্যাঙ্কারে করে ফার্নেস অয়েল এনে সুন্দরবন সন্নিহিত মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে চালানো হবে বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খবরে শুধু পরিবেশবাদীরাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও  সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হচ্ছে ফানের্স অয়েল। আমরা সুন্দরবনে আর একটি শেলা ট্রাজেডি দেখতে চাইনা। ১৯৯৭ সালের জাতীয় পরিবেশ কমিটির ৪র্থ সভার (৩,৪,৫) সিদ্ধান্ত ও আমার দায়ের করা হাইকোটের রিট মামলায় (১২৪৬৭/২০১৭) সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকাতে বিপজ্জনক শ্রেণীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধী নই তবে সুন্দরবনকে আর অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের ইসিএভুক্ত এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মাণাধীন পাওয়ারপ্যাক ১০০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জানান, (চড়বিৎঢ়ধপ গঁঃরধৎধ কযঁষহধ চড়বিৎ চষধহঃ খঃফ.) নামের এই বেসরকারি কোম্পানিটি ২০১২ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পায়। আর ২০১৭ সালে মোংলা বন্দর সংলগ্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে এটি স্থাপনের জন্য আবেদন করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্ট ও পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছেন দাবি করে তিনি আরও বলেন, প্রকল্প এলাকার মাটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। ডিজাইনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন পাইলিংয়ের কাজ চলছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবে না দাবি করে তিনি জানান, যে কোন দিন শুরু হবে মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ।

এদিকে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে ইতিমধ্যেই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। নির্মাণাধীন পাওয়ারপ্যাক বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ করতে না দিয়েই এই কোম্পানিটির ২শ’ একর জমির উপর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ একাধিক লাল বিপজ্জনক শ্রেণীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাইবোর্ড দিয়ে পুরো দমে চালাচ্ছে বালু ভরাটসহ সড়ক, পাইলিং ও অবেকাঠামো নির্মাণ কাজ।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার জানান, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। রামপাল-মোংলা আমার নির্বাচনী এলাকা। সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ১০ কিলোমিটার ইসিএভুক্ত এলাকাতে বিপজ্জনক শ্রেণীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দেয়া হবে না। সুন্দরবন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এই ম্যানগ্রোভ বন ‘দেশের অক্সিজেনের ভান্ডার। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষায় সরকার সচেতন রয়েছে। তাই মোংলায় পরিবেশ দূষণ করার মত কোন প্রতিষ্ঠান পরিবেশ ছাড়পত্র পাবেনা। এখন থেকে মোংলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ভারী বা বিপজ্জনক শ্রেণীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপাশে করতে হবে।


বিষয়: সুন্দরবন



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top