ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


হাঁসের খামার দিয়েই স্বাবলম্বি নাটোরের শরিফুল


প্রকাশিত:
২৭ নভেম্বর ২০১৯ ০১:২৮

আপডেট:
২৭ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩০

ফাইল ছবি

পরিবেশ টিভি: দশ বছর আগের কোনো একদিন। অভাবের কারণে নিজের বাড়ির জায়গাটুকুও বিক্রি করে দেন নাটোরের গুরুদাসপুরের বিলশা গ্রামের তরুণ শরিফুল ইসলামের বাবা। গ্রামেই দিনমজুরের কাজ করা শরিফুলও বেশি আয়ের আশায় পাড়ি জমান ঢাকায়। কাজ শুরু করেন একটি তৈরি পোশাক কারখানায়।

শরিফুলের বয়স তখন ১৭। পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। পড়াশোনা করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ঢাকায় গিয়ে কম বেতনের চাকরিতে ঢুকে আরও দিশেহারা হওয়ার উপক্রম। কিন্তু ফেরার উপায় ছিল না। মাস শেষে টাকা পাঠাতে হয় বাড়িতে থাকা মা–বাবা ও ভাইবোনদের জন্য। দুই বছর পর যখন স্থির করলেন গ্রামে ফিরবেন, তখন শরিফুলের কাছে জমা আছে মাত্র আট হাজার টাকা।

সম্প্রতি শরিফুলের গ্রামের বাড়িতে বসে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।এখন তাঁর মাসে আয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আট বছর আগে যে আট হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন, সেই টাকা দিয়ে কিনেছিলেন ১০০টি পাতিহাঁস। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তা বিক্রি করতেন। পরের গল্প বললেন শরিফুল নিজে।

‘১০০টি হাঁস কিনে গ্রামেই ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার শুরু করি। হাঁসের দল নিয়ে বর্ষায় চলনবিলে আর শুকনো মৌসুমে অন্য উপজেলার খেতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুদিন যাওয়ার পর চলনবিলের মাঝখানের এক উঁচু সড়কে তাঁবু আর নেট জাল দিয়ে হাঁসের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক মাস পর হাঁসগুলো ডিম দিতে শুরু করে। ব্যবসার লাভও শুরু হয় তখন থেকেই।’

গত শুক্রবার চলনবিলের বিলশা এলাকায় শরিফুলের খামারে গিয়ে দেখা যায়, চলনবিলের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল। হাঁস দেখাশোনার জন্য তিনি নিয়োগ করেছেন দুই কর্মচারী। বিলের পানিতে ডিঙি ভাসিয়ে হাঁসের দলগুলোর নজরদারি করছেন তাঁরা। সন্ধ্যার আগেই নিয়ে আসেন খামারে।

শরিফুল বলেন, ডিম দেওয়ার পর থেকেই লাভের টাকা দিয়ে খামারে নতুন হাঁস কেনা হয়। কিছু ডিম রাখা হয় বাচ্চা ফোটানোর জন্য। এতে হাঁসের সংখ্যার পাশাপাশি আয়ও বাড়তে থাকে। বর্তমানে ১ হাজার ৬০০ হাঁস আছে খামারে। এর মধ্যে প্রতিদিন ৭৫০ থেকে ৮০০টি হাঁস ডিম দেয়। শীতে হাঁসের ডিমের চাহিদা ও দামও বেশি থাকে। প্রতিটি ডিম গড়ে ৭ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আট হাজার টাকার ডিম বিক্রি হয়। পাইকারেরাও দু-তিন দিন পর খামার থেকে এসব ডিম কিনে নেন।

কর্মচারীরা সন্ধ্যায় খামারে হাঁস নিয়ে ফেরার পর রাতে তা শরিফুল নিজেই দেখাশোনা করেন। রোগবালাইয়ের হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিষেধক ওষুধ মেশানো খাবার নিজেই তৈরি করেন। কোথাও থেকে প্রশিক্ষণ না নিলেও এই কাজগুলো শিখেছেন অন্যদের দেখাদেখি। কাজে লেগেছে টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানও। শরিফুল বলছিলেন, ‘দিনের বেশির ভাগ সময় হাঁসের সঙ্গে কাটানোয় পরিবারের মতো হয়ে গেছে। এখন তাদের গতি–প্রকৃতি দেখেই বুঝতে পারি কখন কী করতে হবে।’

শরিফুলের পরিবারে এখন আছেন বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে। আট বছর আগে শরিফুলের বাবা বাড়ির জমি বিক্রির কিছুদিন পরই মারা যান। হাঁসের খামার করে সে জমিও ফেরত নিয়েছেন শরিফুল। গড়ে তুলেছেন একতলা পাকা বাড়ি। নিজের নামে কিনেছেন দুই বিঘা জমি। আরও ৩০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করেন। প্রতি মাসে আয় হওয়া প্রায় দেড় লাখ টাকার মধ্যে খামারের দুই কর্মচারীর বেতন হিসেবে ৩০ হাজার টাকা আর হাঁসের খাবার কেনার খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা নিজের।

শরিফুল ইসলাম বলেন, ধৈর্য আর পরিশ্রম থাকলে গ্রামেই ভালো কিছু করা সম্ভব। গ্রামে কষ্ট হলেও পরিবারের সমর্থন পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে থাকা যায়। ভাগ্য বদলের আশায় অন্য কোথাও গিয়ে এই সুখ পাওয়া সম্ভব নয়। খুবজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বলেন, শরিফুল কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন। গ্রামের তরুণেরা যদি তাঁকে অনুসরণ করেন, তাহলে অভাব আর বেকারত্ব দুই-ই বিদায় নেবে।

সূত্র: প্রথম আলো




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top