ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

খাল দখল করে সেতু ও শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ


প্রকাশিত:
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:৩৪

আপডেট:
৯ মে ২০২৪ ০২:৪৯

ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা খালের পানি ব্যবহার করে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হতো। কিন্তু এ বছর পানির অভাবে বীজতলা তৈরি করতে পারছেন না কৃষকেরা। কারণ, এই খাল দখল করে ইচ্ছেমতো সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ১০ কিলোমিটার লম্বা খালের প্রবেশমুখের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে ২৪টি। এরই মধ্যে ১৫টি সেতু নির্মাণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। এখন আরও ৯টি সেতু নির্মাণ করছেন স্থানীয় মানুষ।

সেতু নির্মাণ ছাড়াও খালের মধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ফলে দখলের কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালটি। নাব্যতা হারিয়ে পানিপ্রবাহ হচ্ছে চরম বাধাগ্রস্ত।

ভোলা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলী সূজা বলছেন, খাল দখল সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। ব্যক্তিগতভাবে খালের ওপর সেতু নির্মাণ পরিবেশসম্মত নয়। শিগগিরই তাঁরা দখলকারীদের উচ্ছেদে নামবেন।

স্থানীয় পরিবেশবিদেরা বলছেন, সড়ক বিভাগ খালটিকে খনন না করে খালের পাশে সড়ক রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা খাল ও সড়ক উভয়ের জন্য হুমকি। বড় ধরনের দুর্যোগ এলে সড়ক বিধ্বস্ত হবে, তখন খালও ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খালটি দ্রুত দখলমুক্ত ও খনন করা জরুরি।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা সদর উপজেলার পরানগঞ্জ-ভোলা-চরফ্যাশন আন্তমহাসড়ক প্রশস্তকরণের কাজ চলমান। এ কাজের অংশ হিসেবে সড়কের দুই পাশে সড়ক সুরক্ষা বাঁধ (গাইড ওয়াল) নির্মাণ করা হচ্ছে। এ মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে বাপ্তা খাল তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে বাপ্তা ইউনিয়নের জুলেখার বিল, চৌদ্দগড় বিল, সুন্দরখালী বিল, চাঁচড়া বিল ও সুদ্রকান্দি বিলে গিয়ে পড়েছে।

দেখা যায়, সড়ক বিভাগের ঠিকাদারের শ্রমিক এ দেড় কিলোমিটার খালের মধ্যে তিনটি স্থানে বাঁধ দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণ করছেন। গাইড ওয়াল নির্মাণ করার কারণে খালের ভেতর আশপাশের মাটি ও ময়লা–আবর্জনা গিয়ে পড়ছে। খালটির এমন হতশ্রী অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন আশপাশের বাসিন্দারাও। তাঁরা তাঁদের বাড়ির সামনে খালের ওপর ব্যক্তিগতভাবে সেতু নির্মাণ করছেন। খালের তীরের গাছপালা কেটে ও মাটি-বালু ফেলায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল। এতে কমে যাচ্ছে খালের প্রস্থ।

মহাজনবাড়ির কাছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুটি সেতু উঠছে। একটি মো. সিদ্দিকুর রহমানের, অপরটি মো. আবদুল্লাহর। সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী বিবি ফাতেমা (৫৫) বলেন, ‘হারা জীবন হাক্কা (সাঁকো) দিয়া পারাইছি। খাল হুগানে সবাই দেহি ব্রিজ বানায়, আমার পুতেও বানাইছে।’

খাল দখল করে সেতু নির্মাণ করছেন নবীউল্যাহ, মো. আলী, আলমগীর হোসেন, দলিল উদ্দিন, আলাউদ্দিন মিঞা ও হারুন মিঞা। জানতে চাইলে মো. আলীর দাবি, তিনি পৌরসভা থেকে মৌখিক অনুমতি এনে সেতু নির্মাণ করছেন।

সড়ক প্রশস্তকরণ ও গাইড ওয়াল নির্মাণকাজের ঠিকাদার মো. আক্তার হোসেনের ভাষ্য, তাঁদের কারণে খালের যতটুকু ভরাট হয়েছে বা নাব্যতা হারিয়েছে, কাজ শেষে তাঁরা বাঁধের মাটি, বর্জ্য, গাছপালা পরিষ্কার করে দেবেন।

সরকারি-বেসরকারিভাবে খাল দখল করায় খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। খালে এখন পানি নেই। এ কারণে জুলেখার বিল, সুন্দরখালী, চৌদ্দগড়, সুদ্রকান্দি ও চাঁচড়া বিল এলাকার চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।


খাল দখল করে দোকানঘর
সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের হাজিরহাট এলাকায় খালের তীরে প্রায় ১২টি দোকান গড়ে উঠেছে। খাল দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করছেন স্থানীয় মো. ফারুক মিঞা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ হাজিরহাট তাঁর দাদা সিদ্দিকুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সড়ক বিভাগ ও এলজিইডি তাঁদের অনেক জমি নিয়ে গেছে। তাই তারাও মুখসা (বাড়ির সামনের জমি) দাবি করে খালের মধ্যে সরু পাকা পিলার তুলে ভবন তুলছেন। যদি সরকার ভেঙে দেয় দিক।

ফারুক মিঞা ছাড়াও পাকা ঘর তুলেছেন মো. কামাল ওরফে বিডিআর কামাল। বাঁশ, কাঠ, সুপারিগাছ দিয়ে আরও টিনের দোকান তুলেছেন আবদুল হাই, মো. সিরাজসহ কয়েকজন। তাঁরা জানান, তাঁরা অস্থায়ী ঘর তুলে কোনোরকম ব্যবসা করছেন। সরকার বললে তাঁরা উঠে যাবেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. কালু (৬৫) বলেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে খাল দখল করায় খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। খালে এখন পানি নেই। এ কারণে জুলেখার বিল, সুন্দরখালী, চৌদ্দগড়, সুদ্রকান্দি ও চাঁচড়া বিল এলাকার চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।

ভোলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম বলেন, বাপ্তা খালের তীরে তারা যে গাইড ওয়াল বা সড়ক সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে, সে বাঁধ দখল করে স্থানীয় লোকজন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সেতু নির্মাণ করছেন। এতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দখলমুক্ত করার জন্য তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এটা ফৌজদারি অপরাধ
স্থানীয় পরিবেশবিদেরা বলছেন, সড়ক বিভাগ খালটিকে খনন না করে খালের পাশে সড়ক রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা খাল ও সড়ক উভয়ের জন্য হুমকি। বড় ধরনের দুর্যোগ এলে সড়ক বিধ্বস্ত হবে, তখন খালও ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খালটি দ্রুত দখলমুক্ত ও খনন করা জরুরি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, খাল ও নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা ফৌজদারি অপরাধ। ভোলায় বাপ্তা খাল দখল করে যাঁরা এটা করছেন, স্থানীয় প্রশাসনের উচিত তাঁদের নিবৃত্ত করা অথবা আইনের আওতায় আনা।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top