ঢাকা শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকার স্থাপত্য - শামসুল ওয়ারেস


প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:২৩

আপডেট:
১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৪৯

ফাইল ছবি

পরিবেশ টিভি: ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পার্শ্বে নির্মিত হয় দুটি প্রকল্প—ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি ভবন এবং অদূরে চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় কমপ্লেক্স। আমেরিকান ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত সরকারি স্থপতি মাজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায় নির্মিত ওই প্রকল্প দুটি বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যের ইতিহাস সূচনা করে। যদিও বর্তমান শতাব্দীর বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই বহু সাধ্য-সাধনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উদ্ভাবন ও আন্দোলনের ফল হিসেবে ইউরোপে আধুনিক স্থাপত্য জন্মলাভ করে, তথাপি ১৯৫৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে আধুনিক স্থাপত্য ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত ও উপেক্ষিত। এর জন্য প্রধানত দায়ী ছিল এ দেশে স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি এবং ব্রিটিশ সরকারের সুচিন্তিত উদাসীনতা।

ভারত বিভাগের পরপর ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কমিউনিকেশন বিল্ডিংস অ্যান্ড ইরিগেশন (সিবিঅ্যান্ডআই) মন্ত্রণালয়ে কনসালটিং আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন ব্রিটিশ স্থপতি এডওয়ার্ড চালর্স কোলম্যান হিকস (এফআরআইবিএ)। এই সময় ওই মন্ত্রণালয়ে প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান। তিনি এর আগে দিল্লিতে প্রধান স্থপতি অফিসে হিকসের সঙ্গে কাজ করছিলেন। সেই সূত্রে হিকস কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের অধীনে ঢাকায় আসেন। অবশ্য এরই মধ্যেই ওই মন্ত্রণালয়ে ব্রিটিশ স্থপতি রোনাল্ড ম্যাককোনেল কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের অধীনে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট পদে কার্যরত ছিলেন। ম্যাককোনেল ভারত বিভাগের আগে স্থপতি জেইনসের সঙ্গে কলকাতা সরকারি স্থাপত্য অফিসে কাজ করছিলেন এবং সেখান থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার অফিসে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে হিকস ‘ঢাকা রিপ্ল্যানিং’ নামে একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন। এ প্ল্যানে জমির ব্যবহার অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, নওয়াবপুর বিপণিবিতান (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা), আজিমপুর ও ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিকস এরপর রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, শাহবাগ হোটেল (বর্তমান পি.জি হাসপাতাল), সরকারি নিউমার্কেট, আজিমপুর আবাসিক এস্টেট ইত্যাদি প্রকল্প কাজগুলোর ডিজাইন হাতে নেন। হিকস মোটামুটিভাবে কর্মতত্পর ছিলেন কিন্তু সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় এবং তার কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের মেয়াদ ১৯৫১ সালের ১ মার্চ থেকে বর্ধিত না হওয়ায় এ দেশ ত্যাগ করেন। কনসালটিং আর্কিটেক্ট পদে উন্নীত হন ম্যাককোনেল। তারপর পর্যায়ক্রমে কনসালটিং আর্কিটেক্ট অ্যান্ড টাউন প্ল্যানার, গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট ইত্যাদি পদোন্নতি এবং দীর্ঘ ১৯ বছর সরকারের প্রধান স্থপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের মেয়াদ শেষ করেন। ম্যাককোনেল (আরআইবিএ) তার দীর্ঘ সময়ে বহু সরকারি-বেসরকারি বিল্ডিং ডিজাইন করেন। তার কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলি-ফ্যামিলি হাসপাতাল, ভিকারুন্নেসা নূন বালিকা বিদ্যালয়, হিকসের অসমাপ্ত নিউমার্কেট ও শাহবাগ হোটেল এবং নয়তলা সচিবালয়।

হিকস ও ম্যাককোনেল—উভয় ব্রিটিশ স্থপতি এ দেশে স্থাপত্য সৃষ্টিতে মোটেও যত্নবান ছিলেন না অথবা বলা যায় তারা আদতেই নিম্নমানের স্থপতি ছিলেন। তাদের ডিজাইনে নির্মিত পরিবেশ সাধারণ ঘরবাড়ি থেকে কিছুটা উন্নত হলেও কল্পনাশক্তিবিহীন টানা বারান্দার পার্শ্বে একঘেয়ে সারিবদ্ধ কোঠার যোগফলসর্বস্ব এ ভবনগুলোয় আধুনিক স্থাপত্যের ধ্যান-ধারণার কোনো প্রতিফলন নেই। তাদের স্থাপত্যে স্পেসের ব্যঞ্জনা নেই, কোনো উদ্ভাবনা নেই, অপ্রত্যাশিতের কোনো ভূমিকা নেই, আলো-আঁধারের খেলা নেই, আলো-বাতাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই, ব্যবহারিক কার্যকারিতা নিয়ে ভাবনা নেই, কংক্রিটের ফ্রেম বা ইটের দেয়ালের কোনো বিশেষ বহিঃপ্রকাশ নেই—একেবারেই অতি সাধারণ নির্বুদ্ধি পরিকল্পনা। ফলে এ স্থপতিদ্বয়ের কাজ আধুনিক স্থাপত্যের আলো দেখতে পায়নি।

উন্নত স্থাপত্যের বিকাশের পথে এ রকম অজ্ঞতা ও অবহেলা যখন বিরাজ করছে, ঠিক তখন একক প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্য স্থাপত্যের সমসাময়িক চিন্তাধারাকে আশ্রয় করে উপস্থাপিত হয় ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি এবং চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় কমপ্লেক্স। গ্রন্থাগার ভবন পরিকল্পনা ও বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আধুনিক স্থাপত্যের মহান গুরু লি কর্ব্যুসিয়রের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান, যেমন চতুষ্কোণ ঘনক্ষেত্রবিশিষ্ট (কিউবিক) ভবনের গঠন, ভূসংলগ্ন নিচতলায় খোলা জায়গা, অবাধ মুক্ত স্তম্ভের ব্যবহার ও ভারমুক্ত বিভাজক দেয়াল, কংক্রিটের কাঠামো, সমতল ছাদ, সিঁড়ির পরিবর্তে র্যাম্প এবং বিশেষ করে সূর্যের প্রখরতা কমাতে উদ্ভাবিত লুভ্যার (brlse-soleil)। চারু ও কারু মহাবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও কর্ব্যুসিয়রের প্রভাব লক্ষণীয়। মাটির কাছাকাছি নিচু ছড়ানো (একতলা ও দোতলাবিশিষ্ট) ভবন এবং এর সঙ্গে নিসর্গ স্থাপত্যের মনোরম সমন্বয়। ভবনের বিভিন্ন অংশের বিন্যাস, হালকা গড়ন, কাঠামোগত পরিচ্ছন্নতা ও সর্বোপরি চমকহীন সহজ সৌন্দর্য এ প্রকল্পদ্বয়কে বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মহাবিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জমির সার্ভে ম্যাপ তৈরি করার সময় স্থপতি ইসলাম প্রতিটি গাছের অবস্থান নির্ধারণ করার জন্য অনুরোধ করেন এবং বিভিন্ন গাছের জন্য বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে দেন। এ নিয়ে প্রকৌশলী মহলে তাকে যথেষ্ট বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পঞ্চাশের দশকে যখন আধুনিক স্থাপত্য সম্পর্কিত চেতনার উন্মেষ এ দেশে মোটেও ঘটেনি, তখন গতানুগতিকতার বেড়াজাল ভেঙে এ দুটি ভবনের স্থাপত্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। লাইব্রেরি ভবনে স্থপতির প্রচেষ্টায় চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলামের দেয়ালচিত্র ও পরবর্তীকালে বহিরাঙ্গনে ভাস্কর নভেরা গওহরের আধুনিক ভাস্কর্য সংযোজিত হয় এবং এ দেশে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন শিল্পের সংশ্লেষে উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়।

আইয়ুব সরকারের আমলে নির্মাণকার্য যথেষ্ট ত্বরান্বিত হয়। এ সময় ১৯৫৯ সালের ১২ ও ১৩ জুন নাথিয়াগলিতে ঐতিহাসিক ‘গর্ভন্যান্স কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানেই পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং উল্লেখ করা হয় যে ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানীই হবে জাতীয় সংসদের মুখ্য কার্যালয়। এ প্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে ইসলামাবাদে ডেকে পাঠান এবং ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানী শহরের মাস্টার প্ল্যান ও ডিজাইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাব করেন। স্থপতি ইসলাম এ কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। এবং সেসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনো বিশেষ স্থপতির সাহায্যে এ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য মন্ত্রীর প্রতি পাল্টা প্রস্তাব রাখেন। মন্ত্রী রাজি হওয়ায় স্থপতি ইসলাম ফ্রান্সের লি কর্ব্যুসিয়র, ফিনল্যান্ডের আলভার আলতো এবং আমেরিকার লুই আই কানের নাম প্রস্তাব করেন। কর্ব্যুসিয়র ও আলতো—উভয়ই তাদের অবদানের জন্য এরই মধ্যে পৃথিবীর বিরল মহান স্থপতিগুরুর আসন অধিকার করে আছেন। লুই কান সবেমাত্র ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ও ফিলাডেলফিয়ার রিচার্ডস মেডিকেল সেন্টার নির্মাণ করে বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগান এবং মহান তাত্ত্বিক হিসেবে অধিকতর পরিচিতি লাভ করেন। যা-ই হোক অল্প দিনের মধ্যে প্রথমেই কর্ব্যুসিয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কর্ব্যু অতি ব্যস্ত থাকায় এ কাজের দায়িত্ব নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এরপর আলভার আলতোকে অনুরোধ জানানো হয়, তিনি রাজি হন কিন্তু সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত এসে পথেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার পক্ষে এ কাজের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে অধ্যাপক লুই আই কানকে অনুরোধ করায় তিনি রাজি হন এবং অতি অল্প দিনের মধ্যেই ইসলামাবাদে এসে পৌঁছান এবং ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানী তথা শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আইয়ুব সরকার আমলে ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন দেশের দুই প্রান্তে একটি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের জন্য কমপক্ষে দুটি অনুষদের প্রয়োজন বিধায় ১৯৬১ সালে স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ খোলা হয়। এ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএমএআইডি) সহযোগিতায় টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের শিক্ষকদের এক অংশ ঢাকায় স্থাপত্য বিভাগের গঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে একজন শিক্ষক ও ছয়জন ছাত্র নিয়ে স্থাপত্য বিভাগ শুরু হয়। ১৯৬৪-৬৫ সালের মধ্যে ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮ ও শিক্ষক ৪ জন। এ চার আমেরিকান শিক্ষক হলেন রিচার্ড এডউইন ভ্রুম্যান (ডিন), জেসি ওয়ালডেন, ডানিয়েল সি ডানহাম ও এসটি ল্যানফোর্ড। ১৯৬৬ সালে স্থাপত্য বিভাগ থেকে প্রথম স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্থপতি তৈরি হয়। এরই মধ্যে ছয় প্রকোশলীসহ সাত ব্যক্তিকে আমেরিকার টেক্সাস এঅ্যান্ডএম, ফ্লোরিডা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় এবং পরবর্তীকালে তারাই ১৯৬৮ সালের মধ্যে ফিরে এসে অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৫৯ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উচ্চ পর্যায়ের দল ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ঢাকায় আসে স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার সম্ভাবনা পরীক্ষা করতে। তারা স্থাপত্য শিক্ষাকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতামুক্ত করে ‘আর্ট ওরিয়েন্টেড’ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এমন অবস্থায় আহসান উল্লাহ ইঞ্জিয়ারিং কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়, তাই এ প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক উন্নত বলে স্বীকৃত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্পর্শে এসে স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের প্রস্তাবে এবং জাতীয় শিক্ষা কমিশনের আমন্ত্রণে পেনসিলভানিয়ার প্রতিনিধি দলও ঢাকায় আসে। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগেই লুই আই কান অধ্যাপনা করছিলেন।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম শিবপুর থেকে ১৯৪৬ সালে পুরকৌশল বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে সহকারী প্রকৌশলী পদে সিবিঅ্যান্ডআই মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৫০-৫২ সময়ে ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫৩ সালে অস্থায়ী জুনিয়র সহস্থপতি হিসেবে আবার সরকারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল থেকে লাইব্রেরি এবং চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের পরিকল্পনা প্রণয়নের পর তিনি যেসব প্রকল্পের ডিজাইন করেন, সেগুলো নির্মাণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। একপর্যায় তাকে আর কোনো প্রকল্পের কাজ দেয়া হতো না। ১৯৫৮ সালে তিনি এ পরিস্থিতি নিরসন করার অভিপ্রায়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান পদত্যাগপত্র অগ্রাহ্য করেন। ফলে তাকে কর্মহীন অবস্থায় চাকরিতে বহাল থাকতে হয়। এরই মধ্যে অবশ্য ১৯৫৭ সালে তিনি ট্রপিক্যাল স্কুল অব লন্ডনে পড়াশোনা করেন এবং পরে ১৯৬১ সালে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন এবং দেশে ফিরে সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল হন। এ সময় স্থপতি ইসলামের প্রচেষ্টায় স্থাপত্য ডিরেক্টরেট খোলার নির্দেশ সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রকৌশলীদের বিরোধিতায় তা আর হয়ে ওঠেনি। এ নিয়ে তত্কালীন পূর্তমন্ত্রী মাজমাদারের সঙ্গে আপসহীন মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৬৭ সালে ইসলাম চূড়ান্তভাবে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। অল্পকাল পরেই প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লার সহযোগে বাস্তুকলাবিদ নামে স্থাপত্য কনসালটিং ফার্ম গঠন করেন। বাস্তুকলাবিদ সংগঠন করার পর তিনি যেসব স্থাপত্য কর্মে লিপ্ত ছিলেন, তার মধ্যে নিপা বিল্ডিং (১৯৬৪-৬৭), মতিঝিলে কৃষি ভবন (বিএডিসি, ১৯৬৫), বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন বিল্ডিং (১৯৬৫-৬৬), সম্পূর্ণ নতুন চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসদ্বয়ের সামগ্রিক পরিকল্পনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ডক্টর কুদরত-ই-খুদার উদ্যোগে ১৯৬২ সালে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় ইসলাম ব্যক্তিগত পর্যায়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) কমপ্লেক্স ডিজাইন করেন। স্থপতি ইসলাম প্রখ্যাত স্ট্যানলি টাইগার ম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ডিজাইন করেন। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমির ভবন ডিজাইনের জন্য আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের তত্কালীন প্রধান পাল রুডলফকে কমিশন করার জন্য উদ্যোগ নেন। সে অনুসারে পরবর্তীকালে রুডলফ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কাজের স্বাক্ষর রাখেন। মাজহারুল ইসলামের বিশ্বাস ছিল, এ দেশের সুষ্ঠু, স্থাপত্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে চোখের সামনে কিছু বিখ্যাত স্থাপত্য থাকতে হবে, যা এ দেশের স্থপতিদের চিরকাল অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জোগাবে।

১৯৬০ সালের মার্চে কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স পাকিস্তান লিমিটেড নামক প্রকৌশলী ফার্ম আমেরিকার নিউজার্সিতে কার্যরত লুই বার্জুর ইনকরপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকার বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্স নামক স্থাপত্য ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রধান ছিলেন প্রকৌশলী মকবুলার রহমান ও ডক্টর লুই বার্জার। বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্স ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে স্থাপত্য পেশা অনুশীলন করে এবং মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপত্য নিয়ে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের পরিকল্পনায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লেক্স (১৯৬১-৬৩), কমলাপুর রেলস্টেশন (১৯৬১-৬৩), ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২-৬৫), ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৩-৬৭), নটর ডেম কলেজের ব্রাদার্স হোস্টেল (১৯৬৩), সেন্ট জোসেফ স্কুল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সিস্টার্স হোস্টেল, ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কপোরেশনের স্টুডিও (১৯৬২-৬৫), মতিঝিল কো-অপারেটিভ ব্যাংক (১৯৬২-৬৩) ও ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং ( ১৯৬২-৬৭) ইত্যাদি।

ইতালীয় স্থপতি স্পিরো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান প্রণয়ন করেন। বার্জারের প্রধান স্থপতি ডানিয়েল সি ডানহাম রাজশাহীর ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ইত্যাদি ডিজাইন করেন এবং স্থপতি রবার্ট ব্যুই এরপর ডিজাইন করেন ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন। রবার্ট ব্যুই এরপর ডিজাইন করেন কমলাপুর রেলস্টেশন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস ও ক্লাবঘর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ভবন, তিনটি ছাত্রাবাস ব্যায়ামাগার ও প্যাভিলিয়ন, ব্রাদার্স হোস্টেল, সেন্ট জোসেফ স্কুল ও সিস্টারস হোস্টেল। স্থপতি ডানহাম ডিজাইন করেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান, শিক্ষক ও চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা। রলফ কাইজার (স্থপতি নন) ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজ, উপাচার্যের বাসগৃহ ক্লাব বিল্ডিং ইত্যাদির পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এছাড়া তিনি কো-অপারেটিভ ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং দুটি ডিজাইন করেন। তেজগাঁওয়ের ফিল্ম স্টুডিও ডিজাইন করেন ব্রিটিশ স্থপতি স্ট্যানলি ডিউক স (আরআইবিএ)। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রাবাস ডিজাইন করেন স্থপতি কল জোসেফসন। এছাড়া ১৯৬৪-৬৬ সালে বব মেইয়ার ও জন শিফ নামে দুজন আমেরিকান স্থপতি বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্সে কাজ করেন।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদেশী স্থপতি স্বল্পকালের জন্য এসে এ দেশের সংস্কৃতি ও জলবায়ুর স্পষ্ট ধারণা না নিয়েই ডিজাইনে জড়িয়ে পড়ায় এবং বিভিন্ন স্থপতি একই সাইটে কাজ করায় স্বাভাবিকভাবেই এ ফার্মের কাজে যথেষ্ট সঙ্গতির অভাব লক্ষ করা যায়। তবুও এদের পেশাদার মনোভাব বজায় থাকায় বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্সের কাজ সামগ্রিকভাবে ভদ্র। স্থপতি বব-ব্যুইয়ের কাজ তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্থাপত্যের ভাষা, কারিগরি কর্ষতা ও নন্দন তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে তার কাজ আধুনিক স্থাপত্য মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি স্থাপত্য কাজে যত্ন ছিল। কংক্রিটের ফ্রেম স্ট্রাকচার, ভারমুক্ত বিভাজক দেয়াল, কেন্টিলিভার বারান্দা, কংক্রিটের ফ্রেমজুড়ে উত্তর-দক্ষিণ দিকে কাচের দেয়াল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে তার ডিজাইন সংগঠিত হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যায়ামাগার ও কমলাপুর রেলস্টেশন তার ভিন্নধর্মী সুন্দর কাজ। এ দুটি কাজে প্রকৌশল দক্ষতার পরিচয়ও আমরা তখন পাই। বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রধান প্রকৌশলী মকবুলার রহমান স্থপতি ও প্রকৌশলীদের যেমন নিয়ন্ত্রণ করেন, তেমনি কাজের স্বাধীনতা দেন। ফলে তার অফিসে সুস্থ পেশাদার মনোভাব বজায় থাকে এবং এ ফার্মের কাজের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ আধুনিক স্থাপত্যের প্রতি ধীরে ধীরে কিছুটা আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৯৬০-এর দশক মূলত আইয়ুব শাসনকাল। এ সময় যে কয়েকজন অবাঙালি পুঁজিপতি এ দেশে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার বিস্তার করে, তাদের মধ্যে আদমজী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর একপর্যায়ে ঢাকার অদূরে পাটকল নির্মাণ করে এবং পরবর্তীকালে বৃহদাকারে আদমজী নগর কমপ্লেক্স স্থাপন করে। এ কমপ্লেক্সের সামগ্রিক পরিকল্পনার জন্য করাচির থারিয়ানি অ্যান্ড কোম্পানি নির্বাচিত হয়। এ কোম্পানির মালিক আবুল হোসেন মোহাম্মদ থারিয়ানি বোম্বের জে জে কলেজ থেকে ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত এবং এরই মধ্যে ১৯২৯ সাল থেকে ভারতে স্থাপত্য পেশা অনুশীলন করেছিলেন। আদমজী কমপ্লেক্স ডিজাইন ও নির্মাণ উপলক্ষে ১৯৬১ সালে থারিয়ানি অ্যান্ড কোম্পানি ঢাকায় একটি শাখা অফিস পত্তন করে এবং শিগগিরই এ দেশে বিভিন্ন অবাঙালি শিল্পপতিদের সংস্পর্শে আসে। ফলে ব্যক্তিগত মালিকানা পর্যায়ে যেমন অনেক প্রকল্প তারা ডিজাইন করে, তেমনি সরকারি-আধা সরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ডিজাইন করার সুযোগ পায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে থারিয়ানি অ্যান্ড কোম্পানির মালিকরা (অবাঙালি) বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৯৬১-৭১—এই ১০ বছর এ দেশে অবস্থানকালে তারা ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভবত সবচেয়ে ব্যস্ত স্থাপত্য কনসালটিং ফার্ম। এ সময় তারা বেঙ্গল স্টিল ওয়ার্কস (চট্টগ্রাম ১৯৬৩, ঢাকা ১৯৬৫), বাংলাদেশ অক্সিজেন (খুলনা ১৯৬৫), ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাবরেটরি (মিরপুর ১৯৬৭-৬৯), আইসিআই (নারায়ণগঞ্জ ১৯৬৭-৬৯), এ্যারো টি ফ্যাক্টরি চট্টগ্রাম (১৯৬৭), অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি (১৯৬৭-৭০), আলফা টোব্যাকো (যশোর ১৯৬৮), গুল আহমেদ জুট মিলস (চট্টগ্রাম ১৯৬৮-৭০) ইত্যাদিসহ মোট ৩০টির বেশি বিভিন্ন মিল-কারখানা ডিজাইন করে। এরই মধ্যে হিকস সাহেবের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় তখন অফিস বিল্ডিং নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে।

থারিয়ানি ছিল মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একসময় এ দেশে ব্যবসার প্রসার দেখে বৃদ্ধ আবুল হোসেন মোহাম্মদ থারিয়ানির প্রকৌশলী পুত্র সেলিম থারিয়ানি ঢাকার অফিসে যোগ দেন এবং এ অফিসকে শাখা অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ে পরিণত করেন এবং স্থপতি হিসেবে বিল্ডিং ডিজাইন ও পরিকল্পনা শুরু করেন। নকশা আঁকার প্রবণতা ও সাধারণ লোকের রুচিকে মূলধন করে স্থাপত্যের সমসাময়িক চিন্তাধারা ও রীতিনীতির কোনো খোঁজখবর না রেখে, বিভিন্ন বিদেশী স্থাপত্য পত্রিকা থেকে বিল্ডিংয়ের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ধার করে তারা সাময়িকভাবে জনপ্রিয় এক ধরনের স্থাপত্য সৃষ্টি করে, যার সঙ্গে দেশের জলবায়ু, সংস্কৃতি, নির্মাণ উপকরণের যথাযথ ব্যবহার, আধুনিক নন্দন তত্ত্ব ইত্যাদির কোনো যোগ ছিল না। পাকিস্তানের বিখ্যাত স্থপতি কামিল খান মোমতাজের ভাষায় থারিয়ানিকে সহজেই ‘নকশা নভিস’ বলা যায়। তারা প্রগতিশীল পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন নিজেদের নকশা নিয়ে আপন ভুবনে মোহাচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি অর্থ উপার্জনের সহজলব্ধ উপায় হিসেবে স্থাপত্য শিল্পকে ব্যবহার করে। থারিয়ানি যত প্রকল্প ডিজাইন করার সুযোগ এ দেশে পেয়েছে, ততটা সুযোগ অনেক স্থপতির জীবনেও হয়ে ওঠে না। তবুও একের পর এক উত্তরণের মাধ্যমে কোনো স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে থারিয়ানি সক্ষম হয়নি।

‘যখন যা খুশি, তখন তেমনি’—নীতিতে তৈরি এসব বিল্ডিং প্রকল্প কোনো গ্রহণযোগ্য স্ট্যান্ডার্ড রচনা করতে পারেনি। সত্যিকার অর্থে ভালো কোনো বিল্ডিং তৈরি করার সদিচ্ছাও তাদের ছিল না। একেবারে শেষ পর্যায়ে ১৯৬১ সালে কয়েকজন নবীন স্থপতি ছাড়া তারা কখনো কোনো অভিজ্ঞ ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্থপতি অফিসে রাখেনি। সাধারণ লোককে ধোঁকা দিলেও তারা ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয়, বিশেষ করে আবাসিক গৃহের বেলায়। এ জনপ্রিয়তা তত্কালীন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসকেও প্রভাবিত করে, তারা ডিআইটির মতো একটি জঘন্য বিল্ডিংকে ঢাকা শহরের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনে বহুকাল ধরে ব্যবহার করে।

ষাটের দশকে আরো গুটিকয়েক স্থাপত্য ফার্ম তত্পর ছিল এবং স্থাপত্য অঙ্গনে আরো অনেক ঘটনা ঘটে, যা স্থানাভাবে এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। তবু বিশেষ করে ষাটের দশক সম্পর্কে মন্তব্য করা যায় যে তখন এ দেশে স্থাপত্য সম্পর্কিত অজ্ঞতা, অবহেলা ও অব্যবস্থা যেমন বিরাজ করছিল, পাশাপাশি স্থাপত্যক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়। এ দশকেই এ দেশে স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয় এবং স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্থপতি তৈরি হতে শুরু করে। এ দশকেই লুই আই কান, পাল রুডলফ, ডক্সিয়াডিস, রিচার্ড নয়েট্টা, স্ট্যানলি টাইগার ম্যান—তাদের মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিরা এ দেশের মাটিতে স্থাপত্যের সুফসল ফলায়। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম পাকিস্তান স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি থাকাকালীন ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো উভয় পাকিস্তানের স্থপতিরা একত্র হয়ে সেমিনার সংগঠন করে এবং সমস্বরে স্থাপত্যের জয়ধ্বনি উচ্চারিত হয়। ষাটের দশকে স্থপতিদের অভাব ছিল, অভাব ছিল স্থাপত্য জ্ঞানের, উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়াই ব্যক্তিবিশেষ স্থাপত্য পেশায় নিয়োজিত ছিল, তবু স্থপতিদের মধ্যে ছিল সমঝোতা এবং সাধ্যমতো সমাজকে শ্রেষ্ঠ উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমানে অনেক স্থাপত্য সংস্থা গড়ে উঠেছে কিন্তু ভালো স্থাপত্যের সংখ্যা বাড়েনি। স্থপতিদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দিয়েছে, স্থপতিরা অন্যায় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে, ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যেনতেনভাবে কাজ সমাধা করার প্রবণতা অত্যন্ত ভীতিপ্রদভাবে বেড়েছে। সরকারি স্থপতিরা দায়সারা চাকরি করছেন। স্থাপত্য শিক্ষাঙ্গনের কোনো উন্নতি হয়নি, বরং হয়েছে অবনতি। এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, গ্রন্থাগারে নতুন বই-পুস্তকের শঙ্কাজনক অভাব, স্লাইড, ম্যাগাজিন, জার্নাল সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই (আমেরিকান শেল্টারের দান ছাড়া), আলোকচিত্রের একমাত্র ল্যাবরেটরিটিও অকেজো হয়ে আছে, শুধু টেবিল-চেয়ার নিয়ে স্থাপত্য পড়াশোনা চলছে। চারদিকে সামগ্রিক দুর্যোগ। ষাটের দশকে স্থাপত্য অঙ্গনে যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, তা আজ নিষ্প্রভ।

সূত্র: বণিকবার্তা




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top