ঢাকা শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


একনজরে ২০২৩ সালে আবিষ্কৃত শিল্প, নকশা ও প্রত্নতত্ত্বের সেরা বিস্ময়গুলো


প্রকাশিত:
৮ জানুয়ারী ২০২৪ ২০:১৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ২২:১৩

সাগরের অতলে হারানো জাহাজ, লাইব্রেরির আর্কাইভে লুকোনো পুরনো নথি কিংবা রান্নাঘরের দেয়ালের কোঠরে রয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক কোনো নিদর্শন- এসব কিছু থেকেই আমাদের সামনে উঠে আসতে পারে চমকপ্রদ অনেক কিছু। চলুন ২০২৩ সালের তেমন কিছু চমৎকার আবিষ্কার সম্পর্কে জেনে নিই।

এখনো ঝকঝকে ৩০০০ বছরের পুরোনো তরবারি
অষ্টভূজাকৃতির পুরোনো এক তরবারি ব্যাভারিয়ান গোরস্থান থেকে মিলল গত জুনে। ব্রোঞ্জ যুগের এই তরবারির বয়স ৩০০০ বছরেরও বেশি। জার্মানির ডোনাউ-রেইস থেকে উদ্ধার করা এই তরবারির সঙ্গে পাওয়া গেছে তিনজন মানুষের দেহাবশেষও। তরবারিটি নিয়ে হচ্ছে বিস্তর গবেষণাও, যাতে দেখা গেছে তরবারিটি শত্রুকে কচুকাটা করার জন্যই তৈরি হয়েছিল।

আর্কাইভের রহস্য ভেদ করল এআই

সতেরো শতকের শেষদিকের স্প্যানিশ এক নাটকের রচয়িতা কে- তা ছিল অজ্ঞাত। এ বছরের জানুয়ারিতে জানা গেল এটি ফেলিক্স লোপে দে ভেগার কাজ। সেই রহস্য ভেদ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)।

গবেষকরা দেশটির জাতীয় গ্রন্থাগারে ১৩০০ অজ্ঞাত পরিচয় খসড়ার পাঠোদ্ধার ও লেখকের পরিচয় বের করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে।
স্প্যানিশ স্বর্ণযুগের পাণ্ডুলিপিটির নাম ছিল 'দ্য ফ্রেঞ্চউইমেন লরা'। ১৬৩৫ সালে মৃত্যুর আগে ফেলিক্স এটি লিখে গিয়েছিলেন।

লেড জেপেলিনের ছবি রহস্যের সমাধান

ব্রিটিশ রক ব্যান্ড লেড জেপেলিনের ১৯৭১ সালে প্রকাশিত অ্যালবামে লাকড়ির বোঝা পিঠে নিয়ে থাকা সেই ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে। ভিক্টোরিয়ান যুগের শেষদিকের একজন থ্যাচার ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ার জাদুঘরে থাকা ছবি থেকে একজন গবেষক এই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। মূল ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী আরনেস্ট হাওয়ার্ড ফারমার।

লোকটির নাম লট লং কিংবা লংইয়ার। ১৯ শতকে মেরে-তে থাকতেন তিনি। প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক ছবির সমাহারের একটি ছিল এই ছবি। পরবর্তীতে লেড জেপেলিনের ভোকাল রবার্ট প্ল্যান্ট বার্কশায়ারে পাওয়া এই ছবির ওপর ভিত্তি করে কভারের জন্য পোট্রেট আঁকেন।

দুর্বোধ্য লেখা থেকে ট্রুম্যান কাপোতের গল্প উদ্ধার

খ্যাতিমান লেখক ট্রুম্যান কাপোতের লেখা একটি গল্প এ বছর খুঁজে পেয়েছেন 'দ্য স্ট্রান্ড' ম্যাগাজিনের একজন সম্পাদক।

ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে অ্যান্ড্রু এফ গুইলি খুঁজে পেয়েছেন সেই গল্প 'অ্যানাদার ডে ইন প্যারাডাইস'। বেশ দুর্বোধ্য হাতের লেখা থেকে পাঠোদ্ধার করছেন ম্যাগাজিনের কর্মীরা।

হাজার বছর পুরোনো তাঁতে বোনা জুতা

স্প্যানিশ কয়লাখনি থেকে তাঁতে বোনা ২২টি স্যান্ডেল পাওয়া গিয়েছিল ১৮৫৭ সালে। ১৯৭০ এর দশকে কার্বন আইসোটোপ পরীক্ষায় জানা যায়, এটি ৫০০০ বছরের পুরনো। তবে বার্সেলোনার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলোর বয়স ১০০০ বছরের কিছু বেশি। সে সময়ের হিসেবে এমন বুনন চমকপ্রদ তো বটেই।

মোনালিসার নতুন রহস্য উন্মোচন

মোনালিসা কে ছিলেন, কেন তার ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি- তা নিয়ে এখনো বিস্তর জল্পনা চলে। তবে মোনালিসার ছবি থেকে এক্সরে-র মাধ্যমে এবার উন্মোচিত হয়েছে নতুন রহস্য।

এর ভিত্তি-স্তর পরীক্ষা করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, প্লাম্বোনাক্রাইট নামের একটি খনিজ উপাদান রয়েছে মোনালিসার ছবিতে। তেল ও লেড অক্সাইড একত্রে মিশে এই উপাদানটি তৈরি হয়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিই প্রথম মানুষ- যিনি এর ব্যবহার করেছেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্লাশ টয়লেট

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানা গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্লাশ টয়লেটের কথা। ২৪০০ বছরের পুরনো এক লেভেটরি ও বেন্ট পাইপ সে সময়ের চীনের অভিজাত শ্রেণির কথাই মনে করিয়ে দেয়। জি'য়ান শহরের ইউয়েইয়াং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনায় এটি পাওয়া গেছে।
ভাঙা টুকরোগুলো উদ্ধারে সহায়তা করা গবেষক লিউ রুইয়ের মতে, অভিজাত শ্রেণির অল্প কিছু মানুষই এটি ব্যবহার করতে পারতেন।

পিরামিডের গোপন পথ

গত কয়েক বছর ধরেই গিজার গ্রেট পিরামিডের নানা রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। এর ভেতর রয়েছে রহস্যময় এক শূন্যস্থান। অবলোহিত রশ্মি ও কসমিক রশ্মি ব্যবহার করে স্ক্যান পিরামিড প্রজেক্ট কর্মকর্তারা খুঁজে পেয়েছেন মূল প্রবেশ পথের কাছাকাছি ৩০ ফুট দীর্ঘ এক করিডোর।

মার্চে মিশরের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রধান মোস্তফা ওয়াজিরি জানান, প্রবেশপথে মমি ঢোকানো সহজ করতে বা অজানা কোনো প্রকোষ্ঠের গন্তব্য হিসেবে এই করিডোর তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

ড্রোনের সাহায্যে গুহাচিত্র আবিষ্কার

প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের জন্য বিখ্যাত স্পেনের অ্যালিসান্তের এক দুর্গম অঞ্চলে ড্রোন পাঠিয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন গুহায় হরিণ, ছাগল ও মানুষের ছবি আবিষ্কার করে ড্রোন।

সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিসকো জ্যাভিয়ের মোলিনা হার্নান্দেজ জানান, এই গুহাগুলোয় প্রবেশ করা মানুষের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। ড্রোনের সাহায্যে সুপ্রাচীন ছবিগুলো নজরে এসেছে।

সাধারণ স্থান, অসাধারণ শিল্প

প্রতি বছরই বাড়ির পাশ থেকে, নির্মাণ কাজের সময় কিংবা অভিযানে গিয়ে কেউ না কেউ, কিছু না কিছু উদ্ধার করেন। ২০২৩ সালও এর ব্যতিক্রম নয়।

ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের এক পরিবার এ বছর তাদের বাড়িতে অতি পুরোনো এক ছবি খুঁজে পান। এটি ১৭ শতকের চিত্রশিল্পী পিটার ব্রুঘেল দ্য ইয়ঙ্গারের আঁকা ছবি। যা পরে দাগেরো নিলামখানায় চড়া দামে বিক্রি হয়।

ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে রান্নাঘরের দেয়ালে এক দম্পতি ৪০০ বছরের পুরোনো দুটি ম্যুরাল খুঁজে পেয়েছেন। এতে প্রশ্ন জেগেছে, ওই ভবনের অন্যান্য অংশের তুলনায় রান্নাঘরের দেয়ালটি কেন বেশি পুরোনো?

বাকিংহ্যামশায়ারে সুপারমার্কেট করার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রঙ-বেরঙের রোমান মোজাইক খণ্ড, যা হয়তো স্থানীয় কোনো বাড়ির অংশ ছিল।

রাজা অষ্টম হেনরীর হিজিবিজি কাটাকুটি

টিউডর বংশীয় রাজা অষ্টম হেনরীর এক বইয়ের মার্জিনে বিচিত্র আঁকিবুঁকি বা কাটাকুটি দেখতে পেয়েছেন অধ্যাপিকা মিশেলিন হোয়াইট। তার মতে, বইটিতে এমন ১৪টি জায়গা আছে। বইটি উপহার পেয়েছিলেন হেনরী। সেখানে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা, জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা, শত্রুর ধ্বংস কামনাসহ নানা বিষয় ছিল।

উজ্জ্বল সেই দুটো পোর্ট্রেট

চোয়ালের হাড় প্রদর্শন ও ঠোঁট ফিলার কেবল ২১ শতকের সৌন্দর্যচর্চা নয়। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন দুটো পোর্ট্রেটেও দেখা মিলেছে আরোপিত উজ্জ্বলতার।

এক্স-রের মাধ্যমে দেখা গেছে, হ্যান্স হোলবেইন দ্য ইয়ঙ্গারের ১৬ শতাব্দীতে আঁকা একটি ছবিতে তরুণ বণিক ডেরিক বর্নের কমিশনড পোর্ট্রেটে চোয়ালের হাড় আঁকানোর সময় আলাদাভাবে সেগুলোকে তীক্ষ্ণ করেছেন তিনি।

এক শতাব্দী পর মহীয়সী ডায়ানা সিসিলের একটি পোট্রেটে চিত্রশিল্পী কর্নেলিয়াস জনসন তার ঠোঁট মোটা ও চুলের সিঁথি ঘন করে এঁকেছিলেন।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে গলার হার

টাইটানিক ডুবেছে ১৯১২ সালে। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে পড়ে আছে এর ধ্বংসাবশেষ। গভীর জলে অনুসন্ধান চালানো সংস্থা ম্যাজিলান পুরো জাহাজ-জুড়ে অনুসন্ধান চালায়। এতে তারা পেয়েছে একটি গলার হার, যাতে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক হাঙর 'মেগালোডোন'র একটি দাঁত।

ম্যাজিলানের সিইও রিচার্ড পার্কিনসন গলার হারটিকে 'বিস্ময়কর, চমৎকার ও শ্বাসরুদ্ধকর' বলে অভিহিত করেছেন।

সাগরতলে গুপ্তধন

ইতালির সার্ডিনিয়া উপকূলে এক ডুবুরির চোখে পড়ে সাগরতলে ধাতব কী যেন ভাসছে। তিনি গভীরে যান আর খুঁজে পান ৩০০০০-৫০০০০ ব্রোঞ্জ মুদ্রা, যা চতুর্থ শতকের বলে জানা গেছে।

অ্যাম্ফোরে নামের দুই হাতলবিশিষ্ট প্রাচীন রোমান ও গ্রিক পাত্রও উদ্ধার করা হয়েছে সেখান থেকে। এর ফলে এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, যাতে করে মনে হচ্ছে কাছে-পিঠেই কোথাও রয়েছে ডুবন্ত জাহাজ, যাতে রয়েছে আরও আরও গুপ্তধন।

স্টোনহেঞ্জের মতো তীর্থস্থান

রোটারডামের পূর্বে থাকা এক শহরকে এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ এক ভূমি বলা চলে।

টিয়েলে ২০১৭ সাল থেকে চলছে খনন কাজ। সেখানে উন্মুক্ত করা হয়েছে ৪০০০ বছরের পুরনো এক তীর্থস্থান। সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল এটি। এতে নৈবেদ্য হিসেবে ধনসম্পদ ও প্রাণীর কঙ্কালও মিলেছে। ব্রোঞ্জের তৈরি বর্শা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কবরও।

এই তীর্থস্থান একদা ছিল জনসমাগমে পূর্ণ। বছরের বিশেষ দিনগুলোয় পূজা-অর্চনা, প্রার্থনা ও মৃতদের কবর দেওয়া হতো এখানে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পোলগুলো মিছিলের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top