পাহাড়পুরে সোমপুর বৌদ্ধ বিহার: ভুলে যাওয়া এক সভ্যতার কাহিনী
সোমপুর বিহার, খুঁজে পাওয়া শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে পুরোনাম শ্রী সোমপুর-শ্রী- ধার্মপালদেব-মহাবিহার-ভিক্ষু সঙ্ঘ। অনেক পন্ডিতের মনে করেন এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার। বাংলাদেশে অবস্থিত তিনটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে এই বিহারটি অন্যতম। বাকি দুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হলো বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।
এক নজরে পাহাড়পুরের ইতিহাস
সোমপুর বিহারের অবস্থান বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত নওগাঁ জেলার, বদলগাছি উপজেলার, পাহাড়পুর ইউনিয়নে। তাই অনেকের কাছেই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামে বেশি পরিচিত সোমপুর বিহার। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী প্রাচীন বঙ্গ জনপদে সুদীর্ঘ চার শতক রাজত্ব করেছিল পাল বংশ। মূলত বাংলা ও বিহার কেন্দ্রিক পাল রাজ্য, সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তর পশ্চিমে পাকিস্তানের খায়বার-পাখতুনখওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল বংশের রাজারা ছিলেন নিষ্টাবান বৌদ্ধ। ধারণা করা হয় পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপালের সময়ই নির্মিত হয়েছিল সোমপুর বৌদ্ধবিহার। তবে অনেকে এও ধারণা করেন ধর্মপাল নন তার পুত্র রাজা দেবপাল ছিলেন এই বিহারের নির্মাতা কারণ, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ “পাগ সাম জোন ঝাং” এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। তবে যার সময়ই নির্মাণ হোক না কেন সোমপুর বিহার স্থাপত্য শিল্পে অনন্য এবং আকারে সুবৃহৎ।
মাটির ঢিবির নিচে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা এই প্রকান্ড স্থাপনা দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মতই মনে হতো। পাহাড়পুর ইউনিয়নের নামকরণ কিন্তু সেই থেকেই। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সুদূর চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে বৌদ্ধরা আসতেন এখানে। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। মহাপন্ডিত অতীশের জ্ঞানের সুখ্যাতি বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর তিব্বতে। প্রচলিত আছে তিব্বতে গিয়ে তিনি সেখানকার পানির সমস্যা সমাধান করে এসেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের বাড়ি ছিল ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে।
এক সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সাধকদের জ্ঞানতীর্থ, এই বিহার মাটির নিচে চাপা পড়েছিল সুদীর্ঘকাল। মোটামুটি ছয়’শ বছর স্মৃতির অতলে হারিয়ে থাকার পর পুনরায় এর হদিস মেলে ইংরেজ আমলে ভূমি জরিপের সময় ১৮০৭-১৮১২ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে । তারপর স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিমহাম ১৮৭৯ দিকে এবং ব্রিটিশ ভারতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯২০ এর দশকে আংশিক খনন কাজ চালায়। অবশেষ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ র দশকে এর খনন কাজ পুরোদমে শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করে।
জেনে নিই পাহাড়পুরের স্থাপত্য শিল্পের হিসাব নিকাশ
প্রায় ২৭ একর জায়গা জুড়ে বিহারটি বিস্তৃত। এতে রয়েছে ১৭৭ টি কক্ষ। মাঝখানে প্রকাণ্ড মন্দিরটিকেই মূলত দূর থেকে পাহাড়ের মত দেখায়। এ মন্দিরের বেইসমেন্ট ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত এবং কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। মন্দিরের বর্তমান উচ্চতা ২১ মিটারের মত। তবে ধারণা করা হয় একসময় হয়ত ৩০ মিটারের বেশি ছিল এই মন্দিরের উচ্চতা। অবশ্য নওগাঁ এলাকার স্থানীয়দের মতে দিন দিন ডেবে যাচ্ছে মূল মন্দিরটা, আশির দশকে খনন কাজ শুরু সময়কার উচ্চতা নাকি এখনকার চেয়েও বেশি ছিল। মূল মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের মূর্তির আদলে টেরাকোটাগুলো তৈরি করা হয়েছে।
মন্দিরটিকে ঘিরে চারিদিকে ছিল কক্ষগুলো। ধারণা করা হতো দূর দূরান্ত থেকে আগত তান্ত্রিক সাধক ও শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা অবস্থান করতেন এই ঘরগুলোতে। কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪.২৬ মিটার এবং প্রস্থ ৪.১১ মিটার। মূল মন্দিরকে বর্গ ক্ষেত্রের মতো বেষ্টন করে আছে কক্ষগুলো। উত্তরদিকে এক সারিতে ৪৫টি এবং বাকি তিনদিকে রয়েছে ৪৪টি করে। শুধু সোমনাথবিহার নয় পাল আমলে বাংলা ও বিহারে অনেকগুলো বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। তিব্বতীয় বর্ণনা অনুসারে সে আমলে পাঁচটি বড় বড় বিহার যাদের মধ্যে সোমপুর একটি বাকি চারটি হল বিক্রমশীলা, নালন্দা, ওদান্তপুত্র এবং রাজশাহীর জগদ্দলবিহার। এই বিহারগুলোর পরস্পরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং অনেকটা এখানাকার দিনের মতো আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কো-লেবোরেশনের মতো।
বিহারটি আকস্মিক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় বাংলায় ক্ষীয়মাণ বৌদ্ধ শাসন, হিন্দুপ্রধান সেনবংশের উত্থান এবং সর্বোপরি তাদের হারিয়ে বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পর নব্য রাজনৈতিক পটভুমিকায় আস্তে আস্তে বিহারটি লোকশুন্য হতে হতে একসময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সেটা প্রায় আজ থেকে আটশ বছর আগের কথা।
প্রায় বার’শ বছর আগের তৈরি করা সোমনাথ বিহারের এই ধ্বংসাবশেষ আপনাকে ক্ষণিকের জন্য নিয়ে যাবে সুদূর অতীত। শেষ বিকেলে প্রতিটি ইটের লালাভ উজ্জ্বলতা হয়ত আপনাকে মনে করিয়ে দিতে থাকবে মাটি চাপা পড়া এক সভ্যতার কথা। হয়ত মূল মন্দিরের গা ঘেঁষে উঠতে উঠতে আপনি কল্পনা করতে থাকবেন এককালের কর্মচঞ্চল এই প্রাঙ্গণের প্রতিচ্ছবি। আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে মহাকালের কাছে নশ্বর মানুষ কত ক্ষুদ্র!
যেভাবে যাবেন পাহাড়পুরে
অসাধারণ এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির কথা শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন কীভাবে যাওয়া যায় পাহাড়পুরে? সেটাই বলছি এবার, ঢাকা থেকে প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে সোজা নওগাঁ শহরে। ঢাকা থেকে নওগাঁর দূরত্ব ২৬০ কিমি। বাসে যেতে সময় লাগবে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। ঢাকার আব্দুল্লাহপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর কিংবা গাবতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে মোটামুটি যেকোন সময়ই নওগাঁ গামী বাস পাওয়া যায়। নন এসি বাসের ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকার মতো। এসি বাসের ভাড়া মোটামুটি আটশ টাকার কাছাকাছি। তবে সময় ও সার্ভিস অনুসারে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে।
হানিফ, শ্যামলী, এসআর, ডিপজল সহ আরও অনেক বাস সার্ভিস চালু আছে এই রোডে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, যমুনা সেতু, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে বাস পৌঁছে যাবে নওগাঁ শহরে। যারা ট্রেনে যাতায়ত করতে ভালবাসেন তাদের জন্যও রয়েছে নওগাঁ যাওয়ার সুব্যবস্থা। নওগাঁ শহরের অদূরেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেলজশন শান্তাহার রেলজংশন অবস্থিত। চাইলে বাংলাদেশের মোটামুটি যেকোন প্রান্ত থেকেই শান্তাহারগামী ট্রেনে চড়ে সোজা চলে আসতে পারেন নওগাঁ শহরে। শান্তাহার থেকে নওগাঁ যেতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগেনা। ছোট যমুনার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা নওগাঁ শহর হিসাবে অত্যন্ত ছিমছাম ও নিরিবিলি। শহরে থেকে খুব সহজেই পাহাড়পুর যাওয়া যায়। দল বেঁধে গেলে মাইক্রবাস ভাড়া করে যেতে পারেন সময় লাগবে মোটামুটি ১ ঘণ্টার মত। ভাড়া নেবে ১৫০০-২০০০ এর মত। শহর থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব মোটামুটি ৩২ কিলোমিটারের মতো। আসে পাশের খাবার দাবারের ব্যবস্থা খুব একটা ভাল নেই। তাই নওগাঁ থেকেই খাবার নিয়ে গেলে ভাল হয়। দূর থেকে সোমপুর বিহার দেখতে অনেকটা টিলার মত। সাইটে ঢোকার সময় প্রথম দর্শনে এটাকে আপনার ঠিক টিলাই মনে হবে।
যেখানে থাকবেন
পাহাড়পুর ছাড়াও নওগাঁ জেলায় আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য তাই শুধু পাহাড়পুর ছাড়াও শুধু নওগাঁ শহরে একদিন কাটিয়ে আসলে মন্দ হবেনা। যেহেতু শহর থেকে পাহাড়পুর মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব চাইলেই নওগাঁ শহরে যেকোন হোটেল রেস্ট হাউজে উঠতে পারেন। যেহেতু খুব নওগাঁ ছোট শহর এবং এখনও সেভাবে পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়নি তাই আগে ভাগেই হোটেল বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভাল। যদি কেউ খুব অল্প সময়েরর জন্য যেতে চান এবং সাইটেই রাত কাটাতে চান তাদের জন্য আদর্শ হতে পারে পাহাড়পুর প্রত্নতত্ত্ব রেস্ট হাউস। মূল সংরক্ষিত এলাকার মধ্যেই ছোট্ট পরিসরে প্রত্নত্তত্ব অধিদপ্তরের এই রেস্ট হাউস বুকিং করে রাখতে হবে কিন্তু আগে থেকেই! নিচে নওগাঁ শহরের কয়েকটি হোটেল এবং পাহাড়পুর প্রত্নতত্ত্ব রেস্ট হাউসের ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হল। চাইলে নওগাঁয় এক রাত না থেকেই দিন গিয়ে দিনেই পাহাড়পুর দেখে ঢাকায় ফিরে আসা যায়। অবশ্য যারা একরাত কাটাতে চান তাদের বলছি আগে থেকে যোগাযোগ না করে গেলে কিন্তু বিপদে পড়তে পারেন।
1. হোটেল আগমনী অবস্থান: মুক্তির মোড়, নওগাঁ.
2. হোটেল অবকাশ অবস্থান: শান্তাহার রোড নওগাঁ
3. আফসার রেস্ট হাউস সদর হাসপাতাল রোড, নওগাঁ
4. পাহাড়পুর প্রত্নতত্ত্ব রেস্ট হাউস, পাহাড়পুর
খোলা বন্ধের সময় সূচি
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের পাশেই গড়ে উঠেছে প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর। পাহাড়পুর এবং আসে পাশের আর্কিওলজিকাল সাইটগুলো থেকে সংগ্রহ করা পুরাকীর্তি দেখতে চাইলে মিউজিয়ামটিতে ঢু মেরে আসতে ভুলবেন না যেন।
জাদুঘর বন্ধ ও খোলা থাকার সূচি দেওয়া হলঃ
১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর
খোলা থাকবে সোম থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০:০০ থেকে বিকেল ৬:০০ পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরের খাবাবের বিরতি দুপুর ১:০০ থেকে দুপুর ২:০০ পর্যন্ত। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। দুপুরের খাবার ও জুম্মার নামাজের বিরতি (দুপুর ১২:৩০ থেকে দুপুর ২:৩০)
১ অক্টোবর থেকে ৩০ মার্চ
খোলা থাকবে সোম থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরের খাবাবের বিরতি দুপুর ১:০০ থেকে দুপুর ২:০০ পর্যন্ত। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। দুপুরের খাবার ও জুম্মার নামাজের বিরতি (দুপুর ১২:৩০ থেকে দুপুর ২:৩০)
রমজানে সময়সুচি
রমজানে শুক্রবার ব্যতীত বাকি দিনগুলোতে সকাল ১০:০০ থেকে বিকেল ৪:০০ পর্যন্ত খোলা থাকবে।
শনি ও রবিবার মিউজিয়ামের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এছাড়া সরকার ঘোষিত যেকোন ছুটির দিনে বন্ধ থাকবে মিউজিয়াম।
তাহলে আর দেরি নয়, সামনের কোন এক ছুটিতে সপরিবারে কিংবা বন্ধুরা মিলে ঘুরে আসুন সহস্র বছর আগের স্মৃতিবিজড়িত সোমপুর বিহারে।
সূত্র: রোয়ার বাংলা
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: