বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি শিশু প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকিতে ॥ ইউনিসেফ
বাংলাদেশে দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোতে বসবাস করছে এক কোটি ৯০ লাখেরও বেশি শিশু। তারা ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকিতে রয়েছে। অনেকে আবার বাস্তুচ্যুত হয়ে পরিবারের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। সেখানে তারা আবার মুখোমুখি হচ্ছে নতুন হুমকির।
গত ৫ এপ্রিল, ২০১৯-এ, জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা প্রকাশ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও বেশি করে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
সুনির্দিষ্ট সময় পর পর প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতায় বদলে যায় জলবায়ু। মানুষ সৃষ্ট কারণেই এই স্বাভাবিক বদলের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে,বিশ্ব বহুদিন থেকে এক আকস্মিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্তি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণায়নের কারণে গলছে হিমবাহের বরফ,উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ,ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি,স্থানচ্যুত হচ্ছে মানু্ষ। অভিবাসী কিংবা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা। এরইমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে,জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই সামনের কাতারে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশি শিশুদের কথা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ১ কোটি ৯৪ লাখ শিশুর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু নদী ভাঙনের এলাকা কিংবা এর কাছাকাছি থাকে। ৪৫ লাখ শিশুর বসবাস উপকূলীয় এলাকায়, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের হুমকিতে থাকতে হয় তাদেরকে। তাছাড়া খরার ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৩০ লাখ শিশু। এসব ঝুঁকির কারণে গ্রাম এলাকার মানুষেরা শহরের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হচ্ছে। আর সেখানে যাওয়ার পর নতুন ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিশুদেরকে। তাহলো: জোরপূর্বক শ্রম কিংবা বাল্য বিয়ের ঝুঁকি। অভাবের তাড়নায় অনেককে শিশু শ্রমে লিপ্ত হচ্ছে। ভরণপোষণ চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক মেয়ে শিশুকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে পরিবার।
ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিমন ইনগ্রাম। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরগুলোতে প্রায় ৬০ লাখ জলবায়ু উদ্বাস্তু রয়েছে এবং এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘বন্যাজনিত বিপর্যয়গুলো চরম পর্যায়ের হয়ে থাকে এবং প্রায় প্রতি বছরই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই বছর একের পর এক বন্যায় ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ ইনগ্রাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে যে শুধু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাই নয়, এর কারণে উপকূলীয় এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে গর্ভবতী নারীরাও বড় ধরনের হুমকিতে রয়েছেন বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ। এতে সেখানকার বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে এবং গর্ভবতী নারীরা প্রিএক্লেমশিয়া ও হাপারটেনশনসহ নানা ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
ইউনিসেফ বলছে, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য হুমকি থেকে দরিদ্রদেরকে বাঁচাতে এরইমধ্যে অনেক কিছু করেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের হুমকিতে থাকা শিশুদের সুনির্দিষ্ট চাহিদার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। বন্যাপ্রবণ এলাকার স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে আরও দায়িত্বশীল করে তোলা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ওপর যেন কোনও শোষণ-নিপীড়ন না হয় তা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির গবেষক ইনগ্রাম।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্বন নির্গমন কমানো এবং এই গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩ দশমিক ৬ ফারেনহাইট) 'বেশ নিচে' রাখার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালে প্যারিসে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের নীতিমালা তৈরি করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিন বছর পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পোল্যান্ডে সম্মিলিত হয়ে ওই ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আইপিসিসি তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে দাবি করেছে,বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ এ সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। তবে আইপিসিসির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়,উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে কার্বন নিঃসরণ সীমিত করতে হবে আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হারে। প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেন,প্যারিস চুক্তিতে বিভিন্ন দেশের সরকার যেই পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য।
বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০১৯-এ নবম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ওই তালিকা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ওই সময়ের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: