ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

সচেতনতাই বজ্রপাত থেকে পরিত্রাণের মূলমন্ত্র


প্রকাশিত:
১৫ আগস্ট ২০২১ ০৪:১৯

আপডেট:
১৭ আগস্ট ২০২১ ১৭:৫৫

 

কালবোশেখি, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা- এ ধরনের দুর্যোগগুলো অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলায় আমাদের দক্ষতা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতের এক ঘটনায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও ৯ জন।

এ ঘটনার আগের দিন রাতে কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওড়ে নৌকায় মাছ ধরতে গিয়ে শ্বশুর-জামাইয়ের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বজ্রপাতে একটি মৃত্যু হলে আরও ১০-১৫ জন আহত হন। এ দুর্ঘটনায় আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যান। আমরা অনেকে হয়তো জানিই না বজ্রপাতে আহতদের বেশির ভাগই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পান না। বজ্রপাতে শুধু মানুষই নয়, গবাদি পশু-পাখিও মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ।

দেশে বিগত বছরগুলোতে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ১৬৪ জন বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছে। আগে মূলত সিলেট ও তৎসলগ্ন হাওড় অঞ্চলে বজ্রপাত হতো। এখন দেশের মধ্য অঞ্চল ও ঘনবসতি এলাকায়ও বজ্রপাত হচ্ছে, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।

মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি, মোবাইল ফোনের সহজ নেটওয়ার্কের জন্য টাওয়ার নির্মাণ, বসতির জন্য বনভূমি উজাড় ও গাছপালা কর্তন, জলাভূমি ভরাট, উঁচু ও বড় বৃক্ষের হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ঝড়-বৃষ্টির সময় আমাদের অসতর্ক চলাফেরার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায়।

গবেষকরা বলছেন, দেশে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয় এবং প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গকিলোমিটারে বজ্রপাতের সংখ্যা ৪০। আমেরিকার নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক বছর আগের এক গবেষণামতে- ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কঙ্গোর কিনমারা ডেমকেপ এলাকায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে এবং জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো লেক এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। সারা বছরের হিসাবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় লেক মারাকাইবো এলাকায়। সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩২টির বেশি বজ্রপাত হয়।

পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার চারভাগের এক ভাগই বাংলাদেশের। ক্ষেত-খামার, খাল-বিল, নদী-নালা এবং ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটে বেশি। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশে পরীক্ষিত মডেল থাকলেও বজ্রপাত ব্যবস্থাপনায় এখনো তা নেই। এ সীমাবদ্ধতা উত্তরণে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।।

সরকারের তরফ থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদে বজ নিরাপত্তা টাওয়ার ও হাওড় এলাকায় একতলা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বজ্রপাতের প্রভাব হ্রাসে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণ কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে ৩৮ লাখ বিভিন্ন ধরনের চারা রোপণ করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে তালগাছ লাগিয়ে মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।

তালগাছের পাশাপাশি সুপারি ও খেজুর গাছ লাগানো ও বনায়নের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। একটি দেশের আয়তনের এক-চর্তুথাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিক বনভূমির পরিমাণ হিসাবে আনলেও তা কোনোভাবেই ২৫ শতাংশ হয় না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনভূমির পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলতে হবে।

জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গান, স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি ও প্রদর্শন এবং বিল্ডিং কোডে বজ্রপাত সম্পর্কিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করছে।

ঝড়, বন্যা, খরা, কালবোশেখি, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত আমাদের নিত্য সমস্যা। বজ্রপাতে যারা মারা যায় তাদের অধিকাংশই জমিতে কাজ করা কৃষক, জেলে, মৎস্যজীবী ও ঘর-গৃহস্থালির কাজ করা মানুষ। তাদের অনেকেই জানেই না বজ্রপাতের সময় কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমিয়ে আনতে বৃক্ষরোপণ ও বিভিন্ন ডিভাইস ইনস্টলেশন, হাওড় অঞ্চলে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে সতর্ক করতে হবে সবার আগে।

সহজ সাবলীল ভাষায় তাদের করণীয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার দৃশ্যমান জায়গায় সাইনবোর্ডে করণীয়গুলো লিখে টাঙিয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের তাদের দাপ্তরিক কাজের জন্য মাঠে যেতেই হয়, এই সুযোগে বজ্রপাত থেকে রক্ষার বিষয়গুলোও আলাপচারিতায় আনা যেতে পারে।

গ্রাম, পাড়া-মহল্লা ও ক্ষেত-খামারে গিয়ে কৃষক, মৎস্যজীবী, মৎস্যচাষীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, উঠান বৈঠক আয়োজনের মাধ্যমে তাদের করণীয়গুলো বুঝিয়ে দিতে হবে, একইসঙ্গে তাদের অন্যান্য অভাব-অভিযোগও শুনতে হবে। এবং তা সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে। এখন সবাই কমবেশি সেলফোন ব্যবহার করেন। তাই সরকারের তরফ থেকে বর্ষাকালে খুদে বার্তার মাধ্যমে তাদের করণীয়গুলো বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। লিফলেট ও পুস্তিকা আকারে সেগুলো তাদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। ভারতের কর্নাটকে বজ্রপাতের ৩০-৪৫ মিনিট আগে সতর্কতামূলক এসএমএস দেওয়া হয়। ভিয়েতনামে টাওয়ার নির্মাণ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বজ্রপাতের মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে।

আমাদের অধিকাংশ আবাসিক ভবনে বজ প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেই। শহর, গ্রাম সব জায়গাতেই এখন বজ্রপাত হচ্ছে। তাই যেখানে যত ধরনের নির্মীয়মাণ ও বিদ্যমান স্থাপনা আছে, তার প্রতিটিতে বজ প্রতিরোধক ব্যবস্থার সংযোজন ঘটাতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দেশের বিভিন্ন মাঠ, প্রান্তর ও রাস্তার পাশে চুম্বকীয় পিলার/শলাকা পুঁতে রাখার কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। অনেকেই বলেন, সেগুলো কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বজ নিরাপত্তা দিত। বিষয়টি যদি সঠিক হয়, তাহলে ওই ধরনের পিলার/শলাকা অন্তত বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে পুনরায় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

সম্প্রতি ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের উদ্যোগে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে। ওই ডিভাইসের আওতায় অন্তত একশ মানুষ বজ্রপাতের সময় নিরাপত্তা পেতে পারে। এটির গুণাগুণ, সক্ষমতা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং সঠিক বিবেচিত হলে সেটি ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। কাছাকাছি জমিতে কাজ করা প্রান্তিক শ্রমজীবীদের গ্রুপ তৈরি করে জিও-এনজিও’র যৌথ উদ্যোগে তাদের মাঝে বিনামূল্যে তা সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত একটি লিফলেটে বর্ণিত পরামর্শ ও নির্দেশাবলীর অনুসরণ বজ্রপাতে জানমালের হেফাজতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বহু আগে থেকেই শুনে আসছি বজ্রপাতে মৃত্যুতে মৃতদেহ মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হয়। তাই কবর থেকে লাশ চুরির ঘটনা ঘটে। আর এজন্য শিবগঞ্জের সেই ১৭টি মৃতদেহ বাড়ির উঠানে দাফন করে কবরের উপর রড-সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। আসলে আর দশটা মৃতদেহের সঙ্গে বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির দেহের কোনো পার্থক্য নেই। আর এটি না জানার কারণেই চুরির এ ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ধরনের কুসংস্কার থেকে সরে আসার জন্য মানুষকে বোঝাতে হবে, মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতন করতে হবে।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বাঁচতে হবে। আর একটুখানি সতর্কতা এ লড়াইয়ের ফলাফলকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে শেড নির্মাণ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইনস্টলেশনের পাশাপাশি বজ্রপাতের আগে ও বজ্রপাত চলাকালীন নিজের করণীয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে প্রতিপালনের মাধ্যমে এ দুর্যোগকে আরও সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

[email protected]

 


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top