ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বৃক্ষ বাঁচাতে আমরা বৃক্ষ হব


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২১ ০৫:৫০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০১:৪২

আমরা কি বৃক্ষ হতে পারব! মানুষ কি বৃক্ষ হতে পারে? কোনো কোনো মানুষ বৃক্ষকে ছাড়িয়ে যায়। আবার কোনো মানুষ বৃক্ষের মতো হতে চায়। কোনো মানুষ মানবিক গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে খুনি হয়। কিন্তু বৃক্ষ খুন করতে পারে না, খুনি হতে পারে না। বৃক্ষের জন্ম হয় প্রাণিকুলের উপকার করার জন্য। আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে আছি তা বৃক্ষের কাছ থেকে পাই। এ ছাড়া বৃক্ষের কাছ থেকে খাদ্য পাই, পরিধেয় বস্ত্র পাই, আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান পাই, জ্বালানি পাই, বিদ্যুতের খুঁটি পাই, নৌকার কাঠ পাই, বৈচিত্র্যপূর্ণ আসবাবপত্র পাই। বৃক্ষ থেকেই তৈরি হয় লঞ্চ-স্টিমার-ট্রাকের প্রয়োজনীয় কাঠামো। এ ছাড়া বৃক্ষ আমাদের মাঠ ফাটা রোদে সুশীতল ছায়া দেয়, জমির উর্বরতা বাড়ায়, ঝড়-ঝঞ্ঝায় আগলে রাখে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, চারপাশের শোভা বাড়ায়, ফুল দেয়, ফল দেয়, সুগন্ধি দেয়, বিষণ্ণতায় প্রশান্তি দেয়, নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির আশ্রয় দেয়, অভাব-অনটনে অর্থের জোগান দেয়, অসুখ-বিসুখে ওষুধ ও পথ্য দেয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখে। বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কাগজ, রেয়ন, দিয়াশলাই, প্যাকিংবক্স ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামালের জোগান আসে পরমবন্ধু বৃক্ষের কাছ থেকে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষকরা ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটি বৃক্ষ মানব সমাজকে কতটা আর্থিক সুবিধা প্রদান করে তার একটা হিসাব তুলে ধরেন- ‘বায়ুদূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে ১০ লাখ টাকার, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয় ৫ লাখ টাকার, বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরাশক্তি বাড়িয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, বৃক্ষে বসবাসকারী প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র ও জ্বালানি কাঠসহ ফল সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকার এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরও ৪০ হাজার টাকা।’ এবার নিশ্চয়ই বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এরপরও আবাসন প্রকল্পের জন্য বন উজাড় করি উৎসবের আমেজ নিয়ে। রাজনৈতিক ক্ষোভ প্রশমন করি বৃক্ষ নিধন করে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বৃক্ষের দেখা মেলে না অবহেলা, অসচেতনতা, হেঁয়ালিপনা আর ভাগ্যের পরিহাসে। আমাদের অর্থলিপ্সার কাছে বৃক্ষ আজ বড় বেশি অসহায়

আমরা ভূত-ভবিষ্যৎ না ভেবে কংক্রিটের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রাকৃতিক শোভাকে ধ্বংস করি। প্রাণকে হত্যা করে নিষ্প্রাণ প্রাসাদ নির্মাণ করি। মনের ভেতর একবারও আমাদের প্রশ্ন জাগে না- যে বৃক্ষ বন্ধুর মতো পাশে থেকে চলার পথ সুগম করে তারই গায়ে কীভাবে কুঠারাঘাত হানি। আমরা কী এতটাই নিষ্ঠুর! মানবতাহীন! পশুত্বের বশবতী! আমরাই না সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব। এই কি আমাদের শ্রেষ্টত্বের উদাহরণ?

আমরা কি দিন দিন খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি! অমানবিক! নিষ্ঠুর! আমরা কি খুব সহজেই ভুলে যাই আমাদের অতীত! আমাদের শেকড়! আমাদের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার স্মৃতি! হাজার হাজার মানুষের শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয়া সেই সড়কের কথা! আমরা কি ভুলে যাই অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-

‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,

যশোর রোডে দু’ধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।

কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,

আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।

ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ,

মাথার ভেতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ...’

একটা দুটো নয়, দুই সহস্রাধিক বৃক্ষ নিধন করা হবে উন্নয়নের রাস্তা প্রশস্ত করতে। এও সম্ভব! আসলে আমাদের চোখ উন্নয়নের মাতাল নেশায় অনেক কিছুই আজ কুয়াশার মতো ঝাপসা দেখছে। আমরা কিছুতেই জমিদার কালী পোদ্দারের কথা মনে রাখতে চাই না। যে মানুষটি ১৮৪২ সালে মাকে সোজা পথ দিয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয়ে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। আর ৮০ কিলোমিটারজুড়ে লাগিয়েছিলেন দ্রুতবর্ধনশীল বৃক্ষ মাকে সুশীতল ছায়া দেয়ার আশায়। শুধু কি মায়ের ছায়ার জন্য বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন তিনি? না, সবাইকেই ছায়া দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আজ কালী পোদ্দারের মা বেঁচে নেই। কালী পোদ্দারও বেঁচে নেই। কিন্তু তার রোপণ করা বৃক্ষগুলো এখনও মানুষকে ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয়, পাখিদের আশ্রয় দেয়, ঝড়-ঝঞ্ঝায় আগলে রাখে। উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে আজ আমরা ঐতিহাসিক বৃক্ষগুলোকে নিধনের পাঁয়তারা করছি। প্রাণের হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বলতা হত্যা করে শবের ওপর সুখী হওয়ার যজ্ঞের আহ্বান করছি। এটা কি সুখ নাকি অসুখ, এই বিবেচনা বোধ আজ আমাদের জাগ্রত করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়–য়া যথার্থই বলেছেন, যিনি গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বানানোর রাস্তা খুঁজে পান না তিনি আবার কেমন ইঞ্জিনিয়ার?

সময় বড় নিষ্ঠুর সময়ের ইন্দ্রজালে বন্দি। জাগতে হবে আমাদের। জাগাতে হবে বিবেক। যুগ যুগ ধরে যে বৃক্ষগুলো আমাদের উপকারী বন্ধু হয়ে আগলে রেখেছে, আজ সময় এসেছে তাদের আগলে রাখার। কাঠ ফাটা রোদ থেকে এতদিন আমরা ছায়া পেয়েছি, মায়া পেয়েছি। আজ আমাদেরই বৃক্ষ হয়ে তাদের ছায়া দিতে হবে, মায়া দিতে হবে। কোনো কুঠার নয়, কোনো করাত নয়, মানুষ হয়ে উপকারীর উপকারিতা স্বীকার করে বৃক্ষগুলোকে বাঁচাতে আমাদের আজ বৃক্ষ হতে হবে। বৃক্ষ বাঁচাতে আমরাই বৃক্ষ হব।

মুকিত মজুমদার বাবু 
চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top