ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

অচিরেই প্রয়োজন জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ - কামরুল ইসলাম চৌধুরী


প্রকাশিত:
২৭ অক্টোবর ২০১৯ ১১:১৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৩৯

কামরুল ইসলাম চৌধুরী, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম

জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান দেড় দশক আগে ঢাকায় এসে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কফি আনানের সেই হুঁশিয়ারির সঙ্গে বিজ্ঞানীরা একমত যে, বাংলাদেশ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে। আবহাওয়া পরিবর্তনের নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র এক মিটার বাড়লেই দেশের সাড়ে ১৭ শতাংশ ভূমি সাগরতলে হারিয়ে যাবে চিরতরে। কয়েক কোটি লোক পরিবেশ আর জলবায়ু শরণার্থী হবে। বিশ্বের সবচেয়ে যে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, তা সাগরকোলে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে।

মোট কথা হলো, বাংলাদেশের পরিবেশ সমস্যা আর সংকট এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক আলোচিত বিষয়। আমাদের আর্সেনিক সমস্যা, ঢাকা মহানগরীর বায়ুদূষণের সংকট বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যারা মাথা ঘামান, তাদের উৎকণ্ঠিত করে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ দেশের পরিবেশ ভাগ্য-বিধাতারা সে ব্যাপারে এখনও তেমন উচ্চকণ্ঠ নন। অথচ পরিবেশ খাতে বাংলাদেশের রয়েছে বেশ কিছু সাফল্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দানকারী বেশ কিছু পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদী রয়েছেন আমাদের। বিশ্বজুড়ে গর্ব করে বলার মতো আমাদের রয়েছে প্রথম পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা। তবু পরিবেশের সব মাপকাঠিতেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়া এক দেশ। পরিবেশের ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম শিকারও। ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল এ দেশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ আচ্ছাদন। অবাধে উজাড় হচ্ছে বনরাজি। সুন্দরবন, মধুপুরের শালবন, পার্বত্য বন-বনানী আজ হুমকির সম্মুখীন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলীসহ নদ-নদীগুলোতে চলছে নির্লজ্জ দখলদারিত্ব। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, আর্সেনিকদূষণ আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচি সত্ত্বেও আমাদের পরিবেশের অবক্ষয় ঘটে চলছে দ্রুতগতিতে। পরিবেশবিষয়ক আইন ও বিধিবিধানের ফাঁকফোকর এবং শিথিল প্রয়োগের সুযোগে চলছে নির্বিচার এ ধ্বংসযজ্ঞ এবং ক্রমাবনতি। বাংলাদেশ ব্যাপক জনসংখ্যার ছোট এক দেশ। ১৯৭০ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ কোটিতে। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে ২০০০ জন। শতাব্দী শেষে লোকসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে প্রায় তিন গুণ হচ্ছে। আর এ জন্য দেশটির প্রধান শঙ্কার কারণ হচ্ছে, টেকসই পরিবেশ বজায় রাখা যাবে কতটুকু? কার্যকর জীবনযাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আমাদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অথবা উপকূলীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক জীবন, এর কৃষি ভিত্তি অথবা ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ডতা, বিশ্ব উষ্ণায়ন অথবা টর্নেডোর ভীতি, যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশকে এর পরিবেশ সংরক্ষণে একটি প্রতিরক্ষামূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া পরিবর্তনের এক বড় শিকারে পরিণত হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। এ তো আর অমূলক নয়। দেড় দশক আগে জাতিসংঘ মহাসচিব আনান বাংলাদেশ সফরকালে এ ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। পরবর্তী সব মহাসচিবই সে আশঙ্কার কথা জানিয়ে হুঁশিয়ার করেছেন। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত সম্ভাব্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর আর বন বিভাগের অনেক কর্মকর্তাকে তেমন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

অথচ আমাদের এখানে পরিবেশবাদীদের দাবিতেই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম (এফইজেবি), সংরক্ষণবাদীদের সেই শোরগোলের কারণেই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮৯ সালে। পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। পরিবেশ আন্দোলনের কারণেই জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা (নেমাপ) প্রণীত হয়েছে ১৯৯১-৯৫ সময়কালে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, এনজিও আর পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই অংশীদারিত্বমূলক এই পরিবেশ পরিকল্পনা তৈরি করা হয় সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে। তৃণমূলের মানুষ তাদের পরিবেশ ভাবনা এই কর্মপরিকল্পনায় তুলে ধরে, সমাধানও বাতলে দেয়। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এডাব, এফইজেবি, সিইএনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজটি সম্পন্ন করে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ছাড়াই। প্রণীত হয় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫। তৈরি হয় পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি-১৯৯৭। পরিবেশ আইন ও বিধি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এডাব, সিইএন, বেলা, এফইজেবিসহ নাগরিক সমাজ। নবীন মন্ত্রণালয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সহযোগিতা, বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান ও পরামর্শে পরিবেশ আইন ও বিধি প্রণয়নের মতো জটিল কাজ শুরু হয়। বাস্তবায়িত হয় ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশ কর্মসূচি-টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি। নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি প্রতিনিধিরা একযোগে কাজ করেন। পরিবেশকে ঘিরে রচিত হয় সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার এক অনন্য বন্ধন। নেমাপ অর্জন করে আন্তর্জাতিক প্রশংসা। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার এই বন্ধন বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। ব্রাজিলে '৯২ সালে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিরা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কাজ করেন। ধরিত্রী সম্মেলন-উত্তরকালেও এ ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে রিও+২০ সম্মেলনেও সবাই এক সুরে কথা বলেন। এখন প্রয়োজন সিকি শতাব্দী আগে তৈরি করা নেমাপের অন্যতম প্রণেতা হিসেবে আমি মনে করি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে নেমাপ দলিলের হালনাগাদ করা এখন জরুরি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সদস্য আর গণমাধ্যম কর্মীদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে পরিবেশ বিষয়ক খবরাখবর এখন বেড়েছে। এখন প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ কলাম ইঞ্চি পরিবেশ বিষয়ক রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, ফিচার, আলোকচিত্র দৈনিক কাগজে প্রতিদিন বেরোচ্ছে। নিয়মিত পরিবেশবিষয়ক পাতাও প্রতি সপ্তাহে বেরোচ্ছে কয়েকটি কাগজে। টেলিভিশনে ষাট ও সত্তর দশকে নিয়মিত কোনো পরিবেশবিষয়ক সংবাদ পাওয়া যেত না। এখন বিটিভিতে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে ১০ মিনিট পরিবেশবিষয়ক খবরাখবর ও অনুষ্ঠান থাকছে। গণমাধ্যমের এই ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ সামগ্রিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। বারবার তাই কানে ভেসে আসছে জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থার তদানীন্তন নির্বাহী পরিচালক ক্লাউস ট্রপারের কথা, 'বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ক্ল্যাসিক কেস'। সত্তর দশকে ক্লাউস ছিলেন জার্মান পরিবেশমন্ত্রী। রাইন নদী তখন মারাত্মক দূষিত। তিনি ঝাঁপ দিলেন রাইনে। সাঁতার কাটলেন। ইউরোপের নানা দেশে নানা পরিবেশ জলবায়ু সম্মেলন সেমিনারের যোগ দিতে গিয়ে দেখি, সেই রাইন নদী এখন দূষণমুক্ত। আজ টেমসের বুকে ঢেউ খেলে যায়। অথচ আমাদের বুড়িগঙ্গার জন্য অনেকের মন গলে না। ঢাকার বায়ুতে সিসার পরিমাণ নিয়ে তেমন টনক নড়ে না। আর্সেনিক দূষণে গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি হতদরিদ্র মানুষ আক্রান্ত। নীতিনির্ধারকদের অনেকের সে ব্যাপারে নেই মাথাব্যথা। সত্যি এ যেন এক নির্লজ্জ, ক্ষমাহীন ক্ল্যাসিক কেস। কফি আনানের কথা বোঝার মতো লোকের বড় অভাব এ দেশে। যেমন অভাব কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর (প্রয়াত পরিবেশবাদী ওবায়দুল্লাহ খান) কবিতার সুরেলা ধ্বনি মরমি সুর উদ্ধারকারীর। বাংলাদেশের মাটি, নিসর্গ, প্রকৃতি, শস্য-শ্যামল প্রান্তরের প্রতি অসীম মমত্ববোধসম্পন্ন এমন উচ্চমানের পরিবেশবাদী কবির জন্ম এ দেশে আর হবে কি-না সন্দেহ!

পাশের দেশ ভারতে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগ হচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এ আমাদের আরেক ব্যর্থতা। দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইনগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে জাতির টেকসই উন্নয়ন যাত্রা এগিয়ে যেত অনেক দূর। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, সমন্বয় আর পারস্পরিক সহযোগিতা পরিবেশ সংরক্ষণে আজ অপরিহার্য।

দুই দশক আগে সরকার ঢাকা মহানগরী থেকে টু স্ট্রোক থ্রি হুইলার বেবিট্যাক্সি আর দেশব্যাপী পলিথিন নিষিদ্ধ করায় দেশবাসী পরিবেশগত সুফল ভোগ করতে শুরু করেছিল। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল যৎসামান্য। আমাদের নষ্ট রাজনীতির নকল পুতুল রাজাদের মনে রাখা উচিত, চীনের মতো ১৩৫ কোটি মানুষের দেশও আজ দুনিয়া জোড়া পরিবেশ আন্দোলনের সম্মুখ কাতারে থাকতে আগ্রহী। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে সবুজ জাতীয় আয় গণনার আর সবুজ উন্নয়ন নীতি-কৌশল অনুমোদন তারই প্রমাণ। আরও প্রমাণ চান? কেন, দেখতে পাননি, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কেনিয়ার বিপ্লবী পরিবেশবাদী ওনানদা মাথাই? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নোবেলও পেয়েছেন মার্কিন সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি আল গোর ও আইপিসিসি।

আসুন, আজ আমাদের স্লোগান হোক- হটাও দূষণ, বাঁচাও মানুষ। ক্লাউস, মাথাই, কফি আনানের মতো হাজারো পরিবেশবাদীর জন্ম হোক আমাদের দেশে। আমরা সেই সবুজ বাংলাদেশের সন্ধানে। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের ৩৬ বছর পূর্তির আনন্দঘন মূহূর্তে সেই হোক সবার একান্ত কামনা। তাহলেই হয়তো ধরিত্রীর কাছে আমাদের অনেক ঋণের খানিকটা শোধ হবে। পাখপাখালির কলকাকলি মুখরিত সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের নদীর ঢেউ, কৃষকের ধানের শীষে ভোরের শিশির ফোঁটার অনিন্দ্যকান্তি, পল্লীবধূদের বীজ তুলে রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন, চঞ্চল হরিণ শাবকের প্রকৃতির কোলে নিঃশঙ্ক ছুটে চলা, রাখালের বাঁশির সুরেলা সুমধুর ধ্বনিতে পরিবেশ সংরক্ষণে উজ্জীবিত হোক আমাদের এ দেশ। সবুজ উন্নয়নের পথে টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শরিক হই।


বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
[email protected]




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top