ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০

রাজধানী ঢাকার পানি কিভাবে সরবে ?


প্রকাশিত:
৩ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:১৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:০২

ছবি: সংগৃহীত

বছরের পর বছর কথা হলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পানির নিচে চলে যায় সব৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই৷ তাহলে জলাবদ্ধতা হবে না কেন?

গত কোরবানীর ঈদে ঢাকাবাসী এক নতুন পরিস্থতির মুখোমুখি হয়৷ ওইদিন তুমুল বৃষ্টির কারণে কোরবানীর কিছু এলাকায় পশুর রক্তের সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তা সত্যিকার অর্থেই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা৷ কেউ কেউ তখন এর নাম দেন রক্তাবদ্ধতা৷

পরে এই পশুর রক্তমাখা পানি নেমে গেলেও নিম্নাঞ্চলে জমে যাওয়া এই পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়ায়৷ ছাড়ায় রোগ জীবাণু৷

এ বছর রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে টানা বর্ষণে ঢাকা বলতে গেলে পুরোটাই ডুবে যায়৷ জলজট এবং যানজটে নগরী বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে৷ সেই পানি এখন নেমে গেলেও রাজধানীর অনেক এলাকা, বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল বেশ কিছুদিন পানিতে ডুবে থাকে৷ সেসব অঞ্চলে ঈদ কেটেছে হাঁটু পানিতে৷ কেউ কেউ বাসায় থাকতে না পেরে বাসা পরিবর্তন করছেন৷ কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, যাঁরা এসব বাড়ি বা বস্তিতে থাকেন, তাঁরা চাইলেই বেশি ভাড়ায় নতুন বাড়িতে উঠতে পারেন না৷ ফলে অনেককেই জলাবদ্ধতার সঙ্গেই বসবাস করতে হয়৷

ঢাকায় সাধারণত ২৪ ঘন্টায় ৪০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় না৷ আর এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঢাকায় ২৪ ঘন্টায় ১৩৩ মিলি মিটার বৃষ্টির রেকর্ড আছে৷ এবার বর্ষার আগে থেকেই বৃষ্টির পরিমান বেশি৷ আর সামনে পড়ে আছে পুরো বর্ষা ঋতু৷ তাই আগের হাঁটু পানির জলাবদ্ধতা এখন কোমড় পানির দিকে যাচ্ছে৷ বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকার সড়কে নৌকা চলে৷ সড়ক পথের যানবাহন পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়৷ একমাত্র ভরসা রিকশা৷ তাও পানিতে তলিয়ে যাওয়া খানাখন্দে ভরা সড়কে চলতে গিয়ে যাত্রীসহ প্রায়ই উল্টে যায়৷ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যান রিকশাযাত্রী৷

গত বছরেও ঢাকার শান্তিনগর এলাকা ছিল জলাবদ্ধতার মূল কেন্দ্র৷ কিন্তু এবার বর্ষায় তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে৷ অন্য এলাকায় জলাবদ্ধতা হলেও শান্তিনগরে তেমন হয় না৷ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানায়, বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাঁটু পানি সৃষ্টি হতো৷ দীর্ঘ সময় শেষেও এই পানি সরত না৷ এ অবস্থায় বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ সিটি৷ ফলে চলতি বর্ষা মৌসূমে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা প্রায় ৮০ ভাগ কমে গেছে৷ মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ হলে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আশা দক্ষিণ সিটির৷

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে৷ গত চার বছরে ৩০৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নতি সাধনে৷

বৃষ্টিপাত থেকে যে পানি জমা হয়, তা ‘রানঅফ ওয়াটার' বলে পরিচিত৷ রাজধানীর এই পানি ‘স্টর্ম' ড্রেন দিয়ে নিষ্কাশিত হওয়ার কথা৷ গতবছর থেকে ঢাকা ওয়াসা ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান' বাস্তবায়ন করছে৷ কিন্তু তা শেষ হবে কবে নিশ্চিত নয়।

ঢাকা ওয়াসার একটা প্রধান দায়িত্ব হলো, পানি সরবরাহ এবং শহরের ৩৯% ড্রেনেজ সিস্টেমকে সচল রাখা৷ তা করার জন্য ৬৫ কিলোমিটার খোলাখাল এবং ও বক্সকালভার্ট আছে৷ এছাড়াও এদের আছে ড্রেনেজ পাম্পিং সিস্টেম৷ কিন্তু অসময়ে কিছুই কাজে আসে না৷

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ছয় হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে৷ এর মধ্যে ঢাকার প্রত্যেক নাগরিক ৩৭৭ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে, যার ৯৭ শতাংশই জৈব পদার্থ৷ বাকি ৩ শতাংশ বর্জ্য অজৈব৷ গত ১০ বছরে এ মহানগরীতে বর্জ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷ ১০ বছর আগে দৈনিক তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ হারে অপসারিত হতো এক হাজার ৩৭৬ টন৷ এখন দৈনিক ছয় হাজার ১১০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে অপসারিত হয় চার হাজার ৫৮২ টন৷ এইসব বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ছাড়াও কঠিন বর্জ্য সরাসরি ডাম্পিংয়ে নেয়া হয়৷ তবে বৃষ্টিতে পানি জমলে কঠিন এবং তরল বর্জ্য একাকার হয়ে যায়৷

রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে৷ এর মধ্যে কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলখেতসহ বিভিন্ন এলাকা অন্যতম৷

ঢাকার বেগুনবাড়ি, পান্থপথের বিভিন্ন এলাকা, ধানমণ্ডি, কুড়িল, পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন, শহীদনগর, মধুবাগে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় অল্প বৃষ্টিতেই৷ অলি-গলি হাঁটু থেকে কোমড় পানিতে তলিয়ে যায়৷

পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে৷ এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক নিচু হওয়ায় আশপাশের এলাকাসহ বাসা বাড়ির স্যুয়ারেজের পানি জমে জলাদ্ধতা দেখা দেয়৷

গত বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দু'টি অত্যাধুনিক 'জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন' কিনেছে৷ বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে৷ প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম৷ কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না৷

বৃষ্টি শুরুর পরই জলাবদ্ধতা দূর করতে দুই সিটি কর্পোরেশন তার কাউন্সিলর ও পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সমন্বয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি গঠন করেছে৷ ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম' নামে ওই কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য আছে৷ সে হিসেবে দুই সিটির ৯১টি ওয়ার্ডে ৯১০ জন কর্মী থাকার কথা৷ বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা হলেই এসব কর্মী মাঠে নেমে ড্রেন ও ম্যানহেলগুলোর ঢাকনা খুলে দেবে৷ একই সঙ্গে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নিতে হলে তা-ও করবে৷ কিন্তু জলাবদ্ধতা হলে এসব কর্মীর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না৷

রাজধানীর এই জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসারও৷ কিন্তু এ নিয়ে ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আছে রশি টানাটানি৷ ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা৷ ওয়াসা ২০১৪ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, ‘‘জলাবদ্ধতার দায় ওয়াসা নেবে না৷'' কারণ, ‘‘পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হলেও ওয়াসার চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইনের সংখ্যা বেশি৷ বার্ষিক ক্লিনিংয়ের ব্যাপারেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই৷ এজন্য সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট দেখা দেয়৷''

বিআইডব্লিউটিএ'র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং নগর বিষেশজ্ঞ তোফায়েল আহম্মেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পানির ধর্মকে অস্বীকার করে আমরা ঢাকা শহর থেকে পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছি৷ ঢাকার মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি৷ ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না৷ পানি নীচের দিকে যায়৷ যেতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়৷ ঢাকার প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ করে অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন৷''

তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা কোনো একই উচ্চতার সমতল ভূমি নয়৷ এটা কোথাও উচু আবার কেথাও নিচু আবার কোথাও ঢালু৷ তাই বৃষ্টি হলে ঢালুতে গিয়ে পানি জমা হয়। সেখানে যদি পানির আধার থাকে বা সরে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে পানি জমতে পারে না৷ আমরা পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কার্লভার্ট বানিয়েছি৷ ওই বক্সে পানি যেতে তো সময় লাগে৷ ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়৷ ঢাকা শহরের জিওগ্রাফিক ম্যাপ আছে৷ প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের হিসাব আছে৷ কী পরিমান বৃষ্টিতে কত দ্রুত পানি নিষ্কাশন করলে পানি দাঁড়াতে পারবে না, সেই হিসাব করে আমাদের পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে৷ আর আমার বিচেনায় তা করতে হলে অনেক সিস্টেম ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করতে হবে৷''

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইন্সটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান পরিবেশ টিভিকে বলেন, ‘‘আশির দশকে নগর বন্যার পর ফ্লাড অ্যাকশন প্রোগ্রাম (ফ্যাপ)-এর আওতায় ঢাকার চারপাশ ঘিরে একাংশে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি হয়৷ কিন্তু পুরো কাজ আর হয়নি৷ কথা ছিল ওটা হলে সার্কুলার রোড, ড্রেন এসব তৈরি হবে৷ কিন্তু হয়নি৷ আর ঢাকার চারপাশে নদী৷ থাইল্যান্ডে শহরের ভিতরে ওয়াটার বোট চলে৷ আমাদেরও সুযোগ ছিল৷ কিন্তু আমরা নষ্ট করে ফেলেছি৷ শহরের নদী- খাল ভরাট করে আমরা রাস্তা বানিয়েছি৷ ফলে এখন জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে৷''

তিনি জানান, ‘‘ঢাকা শহরের মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল৷ ওয়াসা বলেছিল, এর মধ্যে কমপক্ষে ২৬টি খালকে রক্ষণাবেক্ষন করে পানিপ্রবাহ সচল রাখবে৷ কিন্তু বাস্তবেতো তা আর হচ্ছে না৷''

তিনি বলেন, ‘‘পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট সিস্টেম এরইমধ্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে৷ শুনেছি, এগুলো নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে৷ পাম্পের মাধ্যমে বিপূল পানি নিস্কাষনের চিন্তা সঠিক নয়৷ কারণ, এটা বিশাল খরচের ব্যাপার৷ তাই ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার আগে ভাবতে হবে৷''

এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘প্রাকৃতিকভাবেই পানি নিষ্কাশনের পথগুলো খুলে দেয়া হলো সহজ পথ৷ আর তা না হলে বিছিন্নভাবে নয়, ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে৷ সারাদেশকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে৷ শুধু ঢাকা নিয়ে পরিকল্পনা করলে তা তেমন ফল আনবে না৷''

বিশ্লেষকরা বলছেন, পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ আছে৷ এক. ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং দুই. খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া৷ ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই৷ এ কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছেই৷

সূত্র: ডয়েচে ভেলে


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top